সরকারি অ্যাম্বাসাডর গাড়িটা এখন ‘আলমারি’। সংগ্রামপুরে চোলাইয়ে বিষক্রিয়ায় মৃতদের সুরতহাল ও ময়না-তদন্ত করার পরে সে সংক্রান্ত কাগজপত্র, ‘ভিসেরা’-সহ নানা খুঁটিনাটি গাড়িতেই ঠাসছিলেন দক্ষিণ ২৪ পরগনার এসিএমওএইচ (ময়না-তদন্ত) উমাপ্রসন্ন ঘোষাল। বুধবার বিকেল থেকে সেই গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে ডায়মন্ড হারবার হাসপাতালের মর্গের সামনে এক গাছতলায়। গত ৪৮ ঘণ্টা টেবিল-চেয়ার পেতে গাছতলাতেই কাজ করে চলেছে উমাপ্রসন্নবাবুর ‘টিম’।
বুধবার বিকেলে যাওয়ার কথা ছিল আত্মীয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে। সে জন্য ওই দিন দুপুরে আলিপুরের কাঁটাপুকুর মর্গে দ্রুত কাজ সারছিলেন বছর তেতাল্লিশের উমাপ্রসন্ন। বুধবার বেলা সাড়ে ১২টা নাগাদ মহাকরণ থেকে এল ফোন। উমাপ্রসন্নবাবু বললেন, “মদে বিষক্রিয়ায় ২০ জন মারা গিয়েছেন বলে খবর পাই। আগেও কয়েকবার ডায়মন্ড হারবার হাসপাতালের মর্গে গিয়েছি। দেখেছি, মৃতদেহের ময়না-তদন্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো সেখানে নেই। ওখানে ময়না-তদন্ত করতে যেতে হলে যাবতীয় সরঞ্জাম নিয়ে যেতে হবে। সে ভাবেই প্রস্তুতি শুরু করি। সহকারীদেরও তৈরি থাকতে বলি।” বুধবার দুপুর দেড়টায় মহাকরণ থেকে পরের ফোন। এ বার নির্দেশ ডায়মন্ড হারবার যেতে হবে। ময়না-তদন্তে প্রয়োজনীয় সুচ, সুতো, ছুরি-কাঁচি, করাত, ‘ভিসেরা’ রাখার ‘জার’, রক্ত-নমুনা রাখার ‘ভায়াল’ নিয়ে রওনা হন উমাপ্রসন্নেরা। |
|
|
উমাপ্রসন্ন ঘোষাল |
ঊর্মিলা মল্লিক |
|
বিকেল ৪টে নাগাদ গন্তব্যে পৌঁছে ওই চিকিৎসকের অভিজ্ঞতা, “মর্গের ভিতরে লাশের স্তূপ। বুঝলাম, সাকুল্যে দেড়শো বর্গফুট জায়গা পাওয়া যাবে ময়না-তদন্তের জন্য। সুরতহাল করার জন্য প্রয়োজন টেবিল-চেয়ার। কিন্তু ওইটুকু জায়গায় সে সব রেখে কাজ করা অসম্ভব। তাই ঠিক করি, মর্গের বাইরে গাছতলাতেই টেবিল-চেয়ার পেতে কাজ করব। আর সব নথি, ভিসেরা রাখার জন্য আমার (সরকারি) গাড়িটা ব্যবহার করব। ওটাই হবে আলমারি।”
শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত সেই ‘আলমারি’তে ১২২টি ময়না-তদন্তের নথি রেখেছেন উমাপ্রসন্ন। গত বছর কাকদ্বীপে নৌকাডুবির ঘটনায় টানা ৬৫টি ময়না-তদন্ত করার অভিজ্ঞতা থাকা ওই চিকিৎসককে সুরতহাল, ময়না-তদন্তের কাজে দুই সহকারী, রিপোর্ট লেখায় দুই পুলিশ অফিসার, আর টেবিলে লাগাতার মৃতদেহ ওঠানো-নামানোয় সাহায্য করেছেন ডোমেরা। অন্যদের সেই সহযোগিতার কথা বলতে বলতেই ওই চিকিৎসক আলাদা করে উল্লেখ করলেন ঊর্মিলা মল্লিকের কথা।
বছর পঞ্চাশের ঊর্মিলাদেবী ডায়মন্ড হারবার হাসপাতালের ডোম। স্বামীও ওই হাসপাতালের ডোম ছিলেন। ২৭ বছর আগে মারা যান। তাঁর জায়গাতেই চাকরি।
স্তূপ থেকে নম্বর মিলিয়ে মৃতদেহ বার করে টেবিলে হাজির করা। ময়না-তদন্তের পরে ফের তা নম্বর মিলিয়ে সাজিয়ে রাখা। দেখে নেওয়া ঠিকমতো সেলাই হয়েছে কি না। পরে সযত্নে ‘প্যাকিং’ করে পরিবারের হাতে দেহ তুলে দেওয়া। সব কাজই বুধবার রাত থেকে সামলাচ্ছেন ঊর্মিলা। দলে ছেলে শঙ্কর-সহ সাত জন। কেমন হচ্ছে কাজ? উমাপ্রসন্নবাবুর কথায়, “ওই মহিলার ‘ম্যান-ম্যানেজমেন্ট’ শেখার মতো। ওঁর জন্যই নির্বিঘ্নে কাজ করতে পারছি।”
ঊর্মিলা অবশ্য বলছেন, “ও সব ম্যানেজমেন্ট-ফেন্ট বুঝি না। স্বামী মারা যাওয়ার পরে এই হাসপাতালই আমার সংসার বাঁচিয়েছে। গত ২৭ বছরে যা শিখেছি, সবটুকুই কাজে লাগিয়েছি। সবাই পরীক্ষায় পাশ করে চাকরি পায়। আমি চাকরি পেয়ে পরীক্ষায় পাশ করার চেষ্টা করেছি। পাশ করেছি কি না, আপনারাই বলবেন।’’ পাশ থেকে উমাপ্রসন্নর মন্তব্য, “অবশ্যই পাশ। একেবারে ফার্স্ট ডিভিশনে।”
আর উমাপ্রসন্নেরা কেমন করলেন? আমরি-অগ্নিকাণ্ডে ময়না-তদন্তের দলের নেতৃত্বে থাকা চিকিৎসক বিশ্বনাথ কাহালি বললেন, “এটা আমাদের পেশা। এ ধরনের চাপ তো নিতেই হয়।” |