দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় এমন অনেক মানুষ আছেন, যাঁরা কোনও দিন সে অর্থে
আলোকবৃত্তে আসেননি। অথচ, তাঁরা গোটা জীবন ধরে জেলার মনন এবং সাংস্কৃতিক
মানচিত্রকে
রঙিন করে তুলেছেন। মাটি থেকে উঠে আসা সেই সব মানুষের কথা। |
বাঁধা মঞ্চ নেই। নেই চড়া আলো, ঝলমলে পোশাক। এমন কী নেই সুন্দরী নারী চরিত্র। বালাই নেই পয়সা দিয়ে টিকিট কাটার।
তবে আছেটা কি!
একটা পুরনো মজবুত সাইকেল। পিছনে কেরিয়ারে বাঁধা পুরনো এক পোর্টম্যান। আর তার ভিতরে?
ভিতরে রয়েছে জাদুকর যাদবচন্দ্র দে’র সাজ-সরঞ্জাম। নানা সাইজের পিস করা বোর্ড। রঙিন কিছু রুমাল। আর ম্যাজিসিয়ানের মতো ছোট্ট একটা জাদুদণ্ড। লোক ভাষায় ‘ভড়কাই’ ডাং। যা দর্শকদের ভড়কে দেয়, গোলমালে ফেলে দেয়। যা দিয়ে অবাক করে জাদুকর হাসতে হাসতে পায়রা ওড়ান। খৈ ছড়ান। বাচ্চাদের প্রিয় ব্র্যান্ডের কোল্ড ড্রিংকসের ভর্তি গ্লাস শুকনো করে দেন হাজার চোখের সামনে। অথবা জাদুদণ্ড হাতে প্লেটভর্তি জাঙ্কফুড নিমেষে উড়িয়ে দেন মহাশূন্যে।
পুরুলিয়া জেলার রঘুনাথপুরে স্ত্রী ও দুই মেয়েকে নিয়ে কষ্টের সংসার জাদুকর যাদবচন্দ্রের। মাটির ঘরে একটি চৌপায়ায় স্ত্রীর সম্বৎসরের ‘তোলা-সংসার’। সমস্ত সামগ্রী দিনে দু’বার নামাতে-ওঠাতে হয়। অভাবের রশিতে আষ্টেপৃষ্ঠ বাঁধা সংসার। তবে বাজিকর যাদবচন্দ্র সব বুঝেশুনেও চুপ থাকেন। তাঁর মাথায় শুধুই নতুন খেলা আবিষ্কারের চিন্তা। পুরনো খেলাগুলো যে স্কুলের বাচ্চারা নিচ্ছে না। নতুন খেলা তৈরি করতে হবে। হঠাৎই মাথায় এসে যায় ‘মাস্টারমশাই’ হওয়ার প্রেরণা।
পড়ুয়াদের আনন্দ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যদি ‘সু’ শিক্ষার ম্যাজিক দেখানো হয়?
যাদবচন্দ্রের মুখেই শোনা যাক সে কথা। “সামান্য পুঁজি আমার। ম্যাজিকের শো করতে গেলে পোশাক, অন্যান্য দামি জিনিসপত্র লাগে। আমার সে ক্ষমতা নেই। ভাবলাম, যা আছে তাই দিয়েই রোজগার করতে হবে। সংসার চালাতে হবে। শো করতে হবে। তাই স্কুলপড়ুয়াদের উপযোগী ম্যাজিক তৈরি করেছি কিছু। পুরনোগুলোও আছে। যেমন, সিগারেট, তামাক, খৈনি খেয়ো না। কেউ খেলে, বারণ করো।” থামলেন জাদুকর।
কিন্তু ম্যাজিকে করে তা বোঝাবেন কেমন করে?
“তিনটে রঙিন ফিতে (দড়িতেও হয়, সবচেয়ে ভাল টাই) ঝলমল করে আমার বাঁ হাতের আঙুলে ঝুলছে। জাদুদণ্ডের সাহায্যে অনবরত রং বদলাচ্ছে। বাচ্চারা অবাক হয়ে দেখছে। ওর মাঝে হঠাৎ সাদা রশি। তাতে লেগে আছে একাধিক ঝুলন্ত সিগারেট। এ বার আমি ডান হাতের জাদুদণ্ড ধরে সিগারেট ফোঁকার মতন করে সিগারেট টানলাম। ধোঁয়া ছাড়লাম। কাশলাম খুব কষে। বুক চেপে বসলাম। ওর ফাঁকেই সিগারেট হাওয়া। ‘ডোন্ট স্মোক। সিগারেট ব্যাড ফর ইয়োর হেল্থ। ব্যাড ফর সাইডে বসা লোকেরও’। জাদুকর খোসলা করে বুঝিয়ে দিলেন বিষয়টা।
আর ফাস্ট ফুড, কোল্ডড্রিংকস-এর ব্যাপারটা?
“ট্রেতে নিলাম দুটি গ্লাস। একটিতে রঙিন জল মানে, কোল্ডড্রিংকস। রঙিন রুমাল চাপা দিলাম। খুললাম। অনবরত দু’টি গ্লাসের জায়গা বদল। রুমাল চাপা দিয়ে খুলে আবার বদল। দর্শকের মন টেনে, কষে বাঁধলাম। ফু-ফু-ফুস্। জাদুদণ্ড ঘোরালাম। রঙিন রুমাল খুললাম। একটি গ্লাসের রঙিন জল উধাও (কোল্ডড্রিংকস)। রইল শুধু জল। ঢক ঢক পান করলাম আমি। পড়ুয়াদের বললাম, ‘পালা-পরবে’ বছরে এক-আধবার খেতে পার কোল্ড ড্রিংকস। কিন্তু দু’বার নয়। এমনি করে ফাস্ট, জাঙ্ক ফুড আসমানে উড়িয়ে দিই।” কিন্তু গরিব জাদুকরের পক্ষে সুন্দর প্লেটভর্তি ফাস্ট ফুডের খেলা দেখানো সব শোয়ে সম্ভব? তারও উত্তর দিলেন জাদুকর। “ম্যাজিক দেখে আনন্দে বাচ্চারা দেয় দু’একটা টাকা। আর স্কুলের তরফে একশো।” প্রতিদিন স্কুল ঘুরে ঘুরে প্রোগ্রাম চাওয়া। কোনও স্কুল বলল, হবে না। পড়ার চাপ। ক্লাস টেস্ট। সামনের মাসে দেখা কোরো। সাঁওতালডি, পারবেলিয়া, বর্ধমান, ঝাড়খণ্ড বর্ডার--এমনি করেই দিন এগিয়ে চলে। |