মরণফাঁদ
‘কানা’ সড়ক
‘কোনা হাইরোড যাওয়ার রাস্তা কোনটা?’ ভট্টনগর বাজারে দাঁড়িয়ে এক দোকানদারকে প্রশ্নটা করলেন এক যুবক।
দোকানদার বললেন, ‘বাজার টপকে, সামনের মোড় থেকে বাঁ দিকে ঘুরে ভেড়ি হয়ে সোজা চলে যান।’
রাস্তা জানতে পেরেই যুবকটি মোটরসাইকেল নিয়ে ছুটলেন সে দিকেই। কিন্তু দেখানো রাস্তায় কিছুটা গিয়েই থমকে দাঁড়ালেন। এক পথচারীকে তাঁর প্রশ্ন, ‘এটাই কোনা হাইরোড যাওয়ার রাস্তা?’ উত্তর মিলল, ‘হ্যাঁ, এটাই ভট্টনগর থেকে কোনা হাইরোড যাওয়ার ঘুঘুপাড়া ভেড়ির রোড।’ যুবকটি কিছুটা বিস্মিত।
বিস্ময়ের কারণও আছে। অনেকের কাছেই এই রাস্তা নিয়ে নানা প্রশ্ন, বিস্ময়। কারণ দীর্ঘ দিন সংস্কারের অভাবে প্রায় আড়াই কিমি দীর্ঘ রাস্তার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিপজ্জনক মরণফাঁদ। কোথাও আবার রাস্তা ভেঙে মিশেছে পাশের খালের সঙ্গে। দেখলে মনে হবে কোনও খালের পাড়। যেখানে টাল সামলাতে না পারলেই সোজা খালে পড়ার আশঙ্কা। এখানে রাতের সমস্যা আরও ভায়ানক। অন্ধকার রাস্তায় বোঝাই দায়, খাল ও রাস্তা কোনটা। অভিযোগ, এ রাস্তা যে হাইরোড তা রাস্তার চেহারা দেখলে কোনও ভাবেই বোঝার উপায় নেই।
বালি জগাছা ব্লকের চকপাড়া-আনন্দনগর পঞ্চায়েতের এই রাস্তার বেহাল অবস্থা সম্পর্কে স্থানীয়দের বক্তব্য: রাস্তা সারানোর জন্য পঞ্চায়েত থেকে জেলা পরিষদ, সর্বত্র আবেদন জানিয়েও ফল হয়নি। এমনকী, দু’বছর আগে ভাঙা রাস্তায় টাল সামলাতে না পেরে খালে পড়ে যায় যাত্রীবোঝাই ছোট গাড়ি। তাতে এক জনের মৃত্যু হলেও টনক নড়েনি প্রশাসনের। যদিও চকপাড়া-আনন্দনগর পঞ্চায়েতের শিল্প পরিকাঠামো সঞ্চালক কাজলচন্দ্র সরকার বলেন, “রাস্তা মেরামতির জন্য জেলা পরিষদ থেকে টাকা পাওয়া গিয়েছে। খুব শীঘ্রই কাজ শুরু হবে।”
লিলুয়ার ভট্টনগর বাজারে শুরু হয়ে কোনা হাইরোডে গিয়ে মিশেছে ঘুঘুপাড়া ভেড়ির রোড। কোনা হাইরোড যাওয়ার সময় রাস্তাটির বাঁদিকেই রয়েছে শেওড়াপোতা খাল। খালটি ভট্টনগর থেকে শুরু হয়ে নাজিরগঞ্জে গঙ্গায় মিশেছে। রাস্তার দু’পাশে রয়েছে আনন্দনগর, ভট্টনগর পশ্চিম, দেশপ্রিয়নগর, সুকান্তপল্লি, মেন ঘুঘু পাড়া এলাকা। বাসিন্দাদের কথায়, শুধু এই পাঁচটি অঞ্চলের মানুষই নন, গোটা লিলুয়া এলাকার মানুষ কোনা হাইরোড যাওয়ার জন্য এই রাস্তার উপরই নির্ভরশীল। আবার বেনারস রোডের যানজট এড়িয়ে সালকিয়া থেকে কোনা হাইরোড যেতে চাইলে এক মাত্র সহজ পথ এই ঘুঘুপাড়া ভেড়ির রোড। প্রতি দিন মোটরসাইকেল, সাইকেল, রিকশা ও ছোট চারচাকার গাড়ি মিলিয়ে গড়ে কয়েক হাজার যানবাহন রাস্তাটি দিয়ে যাতায়াত করে। এই রাস্তা দিয়ে কোনা হাইরোড পৌঁছে সহজেই ৬ নম্বর জাতীয় সড়ক এবং চামরাইল, জগদীশপুর হয়ে হুগলির দিকে যাওয়া যায়।
কিন্তু এমন গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার পুরোটাই পিচ উঠে এবড়োখেবড়ো, মাটি বেরিয়ে গিয়েছে। কোথাও বিশাল গর্ত। আবার কোথাও রাস্তার এক পাশ ভেঙে খালের সঙ্গে মিশে যাওয়ায় ১২ ফুট চওড়া রাস্তা কার্যত আরও সরু হয়েছে। উঁচু-নিচু রাস্তায় যানবাহন চলছে দুলকি চালে। বড় বড় গর্ত বাঁচিয়ে চলতে গিয়ে যানবাহন-চালকেরা একেবারে রাস্তার ধার ঘেঁষে চলছেন। ফলে পথচারীদের বিপজ্জনক ভাবে খালের পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। দু’টি গাড়ি পাশাপাশি যাওয়ারও কোনও উপায় নেই। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, তিন বছর আগে রাস্তাটি পিচ করেছিল হাওড়া জেলা পরিষদ। কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই তৈরি হয়েছে মরণফাঁদ।
বাসিন্দারাই জানালেন, ১২ ফুট চওড়া খালের পাড় ক্রমশ ভাঙছে। ফলে কোথাও খাল ২০ ফুট চওড়াও হয়ে গিয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দা সুনীলদেব রায়ের কথায়: “দু’বছর আগে খালটা সংস্কার হয়েছিল। এ বছর শুধু পানা সাফ হয়েছে। খালের নোংরা জলের জন্য মশা-মাছির খুব উপদ্রব হয়। বর্ষাকালে তো রাস্তা দিয়ে হাঁটাই যায় না।”
এ রাস্তায় রাতের অবস্থা আরও ভয়ানক। পুরো রাস্তায় আলো নেই। যানবাহনের আলো ও স্থানীয় দোকান, বাড়ির আলোই একমাত্র ভরসা। এই রাস্তা দিয়েই প্রায়শ যাতায়াত করেন লিলুয়া চকপাড়া মিলনির বাসিন্দা বিশ্বনাথ কর্মকার। বললেন, “রাতে সাইকেল নিয়ে প্রায়ই কোনার দিকে যেতে হয়। রাস্তাটা চেনা, তবু ভয় হয়, কখন খালে গিয়ে পড়ি। আর উল্টো দিক থেকে আচমকা জোরালো আলো চোখে পড়লে খুব অসুবিধা হয়।”
যদিও রাস্তার এই অবস্থার জন্য সেচ দফতরকেই দায়ী করেছেন বালি জগাছা ব্লকের পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি চৈতালি দেবনাথ। তিনি বলেন, “খাল সংস্কারের সময় নতুন তৈরি করা রাস্তাটি ফের ভেঙে যায়। আমরা সেচ দফতরকে বলেছিলাম রাস্তা সংস্কারের জন্য। ওরা টাকাও দেবে বলেছিল। কিন্তু পরে কিছুই করেনি। সম্প্রতি রাস্তাটি সংস্কারের জন্য জেলা পরিষদ ১২ লক্ষ টাকা অনুমোদন করেছে।”
সেচ দফতরের হাওড়া ডিভিশনের এগজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার রবীন মুখোপাধ্যায় বলেন, “ওই খালের দায়িত্ব আমাদের নয়। ওটা এইচ আই টি-র। তাই যা বলার ওরাই বলতে পারবে।” এইচ আই টি-র চিফ ইঞ্জিনিয়ার মৃন্ময় চট্টোপাধ্যায় বলেন, “খাল সংস্কারের দায়িত্ব এইচ আই টি-র। তবে ভট্টনগরে রাস্তা সারানোর কোনও বিষয় ছিল না। এখন খাল সংস্কারের কাজ চলছে। ভট্টনগরের দিকেও কাজ হবে।”

ছবি: রণজিৎ নন্দী।




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.