বাংলা ভাষায় ‘রাজনৈতিক সংস্কৃতি’ শব্দবন্ধটি অধুনা বহুলপ্রচলিত। কথাটির অর্থ কী? কৃষ্টি বা সংস্কৃতি, যে নামেই ডাকা হউক, ‘কালচার’-এর মধ্যে নিহিত আছে চর্চা তথা অনুশীলন। কী ভাবে রাজনীতির চর্চা বা অনুশীলন ঘটিতেছে, তাহাই রাজনৈতিক সংস্কৃতির নির্ণায়ক। অনুশীলনের নানা দিক থাকে, সেই অনুসারে রাজনৈতিক সংস্কৃতিরও বহু মাত্রা থাকে। পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি মাত্রা সাম্প্রতিক ইতিহাসে বহু-আলোচিত। বস্তুত, অতি-আলোচিত। এক কথায় তাহার নাম ‘আমরা বনাম উহারা’। যে কোনও প্রশ্নকে দলীয় দ্বন্দ্ব হিসাবে প্রতিপন্ন করাইবার মানসিকতা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে বদ্ধমূল। তাহার পিছনে বামপন্থীদের অবদান ঐতিহাসিক কেবল সুদীর্ঘ শাসনের সুবাদেই নয়, তাঁহাদের চিন্তা এবং কার্যপদ্ধতির মৌলিক চরিত্রে দলতন্ত্রের সর্বগ্রাসী আধিপত্যের কারণেও। বিরোধী শিবিরেও একই ব্যাধির সংক্রমণ প্রবল, তাহার কিছুটা শাসকদের আচরণের প্রতিক্রিয়ায়, বাকিটা নিজকীর্তি। দায়ভাগের অনুপাত যাহাই হউক, এই অভ্যাসের পরিণামে পশ্চিমবঙ্গ নামক রাজ্যটির সামগ্রিক স্বার্থ বিপন্ন, বিপর্যস্ত।
সরকার গঠনের সূচনা হইতেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই মানসিক অভ্যাসটিতে পরিবর্তন আনিতে চাহিয়াছেন। তিনি বিভিন্ন প্রশ্নে দলীয় বিভাজনের ঊর্ধ্বে উঠিয়া সহযোগিতার পথে, ঐকমত্যের ভিত্তিতে অগ্রসর হইবার চেষ্টা করিয়াছেন। বিরোধী শিবির হইতেও সাড়া মিলিয়াছে। সমস্ত প্রশ্নকে ‘আমরা বনাম উহারা’র চশমা দিয়া দেখিবার ধারাটি দ্রুত দুর্বল হইয়াছে, বিভিন্ন বিষয়ে দুই পক্ষ একত্র বসিয়া বা কথা বলিয়া সমস্যা মোকাবিলার একটি ধারা তৈয়ারি হইয়াছে, পশ্চিমবঙ্গে যে ধারাকে অভিনব বলিলে অত্যুক্তি হয় না। আমরি-র মর্মান্তিক অগ্নিকাণ্ড হইতে ডায়মন্ড হারবারের মর্মান্তিক চোলাই মদ কাহিনি সেই ধারাই অনুসৃত হইতেছিল, কথায় এবং আচরণে পরস্পরের পাশে দাঁড়াইবার মানসিকতা প্রতিফলিত হইতেছিল। সেই ধারায় ‘মিথানল’-সদৃশ গরল ঢালিয়া দিলেন শিল্প ও পরিষদীয় মন্ত্রী, শাসক জোটের প্রধান শরিক তৃণমূল কংগ্রেসের অভিজ্ঞ নেতা পার্থ চট্টোপাধ্যায়। তিনি চোলাই মদে বিষ-রাসায়নিক মিশাইবার অপরাধে সি পি আই এমের স্থানীয় নেতাদের অভিযুক্ত করিয়াছেন। এবং তাঁহার এই অভিযোগকে পরোক্ষে সমর্থন করিয়াছেন দলের অন্য একাধিক নেতা।
ইহা গভীর ভাবে দুর্ভাগ্যজনক এবং নিন্দনীয়। বিষক্রিয়ায় এমন বিপুলসংখ্যক মানুষের মৃত্যু অত্যন্ত মর্মান্তিক। এই ধরনের ঘটনা যাহাতে আর না ঘটে, তাহার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক এবং আইনি ব্যবস্থা নিশ্চয়ই করা দরকার। কাহারা এই বিষায়নের জন্য দায়ী, তাহা তদন্ত করিয়া বাহির করা জরুরি, অপরাধীদের শাস্তিবিধান জরুরি। সেই অপরাধীরা কোনও রাজনৈতিক দলের সহিত জড়িত কি না, তাহাদের পিছনে দলের প্রশ্রয় বা চক্রান্ত কাজ করিয়াছে কি না, সবই তদন্ত এবং বিচারসাপেক্ষ। এই বিষয়ে অগ্রিম কোনও মন্তব্য করা বা এমনকী পরোক্ষ সন্দেহ প্রকাশ করাও অনুচিত। সি পি আই এমের আব্দুর রেজ্জাক মোল্লাও কার্যত চোলাই মদের বিষক্রিয়ায় দলীয় পরিচয় খুঁজিয়াছেন। তাহাও অবশ্যই অন্যায়। কিন্তু এক পক্ষের অন্যায় আর এক পক্ষের অন্যায়ের যুক্তি হইতে পারে না। সত্য হইল, এই সমাজে বাক্সংযমের অভ্যাস কম। যে কোনও বিষয়ে চক্রান্ত খুঁজিবার প্রবণতাও অত্যধিক। কিন্তু যাঁহারা নেতৃস্থানীয়, তদুপরি প্রশাসনের উচ্চাসনে, তাঁহারা যদি ন্যূনতম বাক্সংযম অনুশীলন করিতে না পারেন, ‘উহারাই অপরাধী’ বলিয়া পাড়া মাথায় করিতে প্রবৃত্ত হন, তবে আর রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন ঘটিবে কী উপায়ে? মুখ্যমন্ত্রী যদি নূতন অভ্যাস অনুশীলনে প্রকৃত অর্থে মনোযোগী হন, তবে তাঁহার কর্তব্য স্বভাবসিদ্ধ স্পষ্ট ভাষায় পার্থবাবুর এই আচরণের নিন্দা করা এবং তাঁহাকে উহা প্রত্যাহার করিতে বলা। দায়িত্ব তাঁহার উপরেই বর্তায়, কারণ তিনি মুখ্যমন্ত্রী। |