জারের দেশে
মস্কোর ঠান্ডাও হার
মানল সম্পর্কের উত্তাপে
হোয়াইট হাউজ থেকে ক্রেমলিনের দূরত্ব কতটা?
আমেরিকার সঙ্গে পরমাণু চুক্তি এবং কৌশলগত সম্পর্ক গড়েও ভারত যে পুরনো বন্ধু রাশিয়াকে কোনও ভাবেই ছাড়তে রাজি নয়, সেটাই আজ আরও একবার স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিলেন মনমোহন সিংহ। রুশ প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভের সঙ্গে বৈঠক সেরে মনমোহন যখন প্রধানমন্ত্রী ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজে বসলেন, তখনও মস্কোর আকাশে সূর্যের দেখা নেই! চার দিক অন্ধকার। হাড় কাঁপানো হিমেল হাওয়ার সঙ্গী গুঁড়ি গুঁড়ি বরফ। এই প্রবল ঠান্ডা আর অন্ধকারকে যেন দূরে সরিয়ে দিল দু’দেশের সম্পর্কের উষ্ণতা। যে উত্তাপ টের পাওয়া গেল প্রতি মুহূর্তে। মনমোহন যেমন পুরনো বন্ধু সম্পর্কে নয়াদিল্লির মনোভাব স্পষ্ট করে দিলেন, তেমনই মস্কোর মনের কথা প্রকাশ করে পুতিনও বুঝিয়ে দিলেন, রাশিয়ার নজর এখন এশিয়ার দিকেই। কেবল চিন নয়, তাঁর প্রয়োজন ভারতকেও।
রুশ প্রধানমন্ত্রীর তরফে এই উষ্ণতা, মনমোহনের পক্ষে আশার বৈকি! কারণ প্রধানমন্ত্রী পদে বসে থাকা এই ভ্লাদিমির ভ্লাদিমিরোভিচ পুতিনই তো আগামী বছর মার্চ মাসে রুশ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ফের লড়বেন বলে ঘোষণা করেছেন।
ক’দিন আগেও রাশিয়ার মাটিতে যাঁর জনপ্রিয়তা ছিল গগনচুম্বী, সেই পুতিন অবশ্য হালে বেশ বিপাকেই। সদ্যসমাপ্ত দুমার নির্বাচনে জয়ের পরেও রিগিংয়ের দায়ে দেশেই নজিরবিহীন বিক্ষোভের মুখে পড়েছেন তিনি। অবশ্য মনমোহন আজ তাঁকে শুভেচ্ছা জানাতে ভোলেননি।
ক্রেমলিনে মনমোহন সিংহ ও ভ্লাদিমির পুতিন। ছবি: পিটিআই
রাশিয়া ইউরোপের নাকি এশিয়ার? এই সত্ত্বার সঙ্কট সোভিয়েত ইউনিয়নের আমল থেকেই। আর এখন ইউরোপের ঘোরতর অর্থনৈতিক সঙ্কটের প্রেক্ষিতে দেশের ভিতর ভয়াবহ বিদ্রোহে পুতিনের জপমন্ত্র ‘ইউরেশিয়া।’ অবশ্য শুধু ভারত নয়, এই রুশ বিদেশনীতিতে চিনের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান সখ্যও নজরকাড়া।
মনমোহন একই ভাবে পুতিনের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক করমর্দনে উৎসাহী ষোল আনার উপরে আঠারো আনা। আজ বৈঠকের পর কেউ কেউ প্রতিরক্ষা চুক্তি থেকে অর্থনৈতিক বোঝাপড়া ভারত কী পেল, পেল না, তার হিসাব কষতেই ব্যস্ত। কিন্তু সাউথ ব্লকের বক্তব্য, ভারত আমেরিকার সঙ্গে পরমাণু চুক্তি করেও যেমন চিনের সঙ্গে কলহমত্ত হতে চায় না, তেমনই পুরনো বন্ধু রাশিয়ার হাতও ছাড়তে চায় না। মৈত্রীর সেই পতাকাই আজ বরফঢাকা মস্কো শহরে উড়িয়ে দিলেন মনমোহন।
আকুলা পারমানবিক ডুবোজাহাজ রাশিয়ার থেকে কিনতে চায় ভারত। কিন্তু ৫০ কোটি ডলার দিয়ে সুখোই কিনতে ভারত চুক্তিবদ্ধ হলেই তেড়েফুঁড়ে ওঠে চিন। সঙ্গে সঙ্গে তারাও রাশিয়ার কাছ থেকে র্যাডার কিনতে চায়। বেজিং জানায়, ওই র্যাডার না দিলে রাশিয়ার সঙ্গে অন্যান্য প্রতিরক্ষা খাতে ৪০০ কোটি ডলারের চুক্তি তারা খারিজ করবে। বাধ্য হয়ে রাশিয়া ওই র্যাডার চিনকে দেয়। চিন কিন্তু সেই র্যাডার বিক্রি করে পাকিস্তানকে! পুতিন-ঘনিষ্ঠ রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের ইভানভ সম্প্রতি দিল্লিতে এসে এই ঘটনা জানিয়ে তাঁদের অসহায়তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে রাশিয়া তেল ও গ্যাসকে এত বেশি অগ্রাধিকার দেয় যে, অন্যান্য শিল্প সে ভাবে বিকশিত হয়নি। এখন অর্থনৈতিক মন্দায় পড়ে তারা ফরমান জারি করেছে, তেল ও গ্যাস নিতে গেলে অন্য দেশকে বিশেষ কর দিতে হবে। ফলে বিপদে পড়েছে ভারতের ওএনজিসি। ভারতের প্রতিনিধি দল পুতিনের কাছে এই কর মকুবের আবেদন জানিয়েছে।
ভারত-মার্কিন পরমাণু চুক্তির পর মস্কোর সঙ্গে নয়াদিল্লির একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। বিশেষত প্রযুক্তি কেনাবেচার ক্ষেত্রে। ভারত আজ স্পষ্ট করে দিয়েছে, আমেরিকার সঙ্গে যে চুক্তিই হোক, ভারত রাশিয়ার সঙ্গেও একই ধরনের চুক্তি করতে প্রস্তুত। তবে হরিপুরই হোক বা কুদানকুলাম যে ধিকি ধিকি অসন্তোষ রয়েছে তা মাথায় রাখতে হচ্ছে দিল্লিকে। পুতিন নিজেও এখন দেশের ভিতর যথেষ্ট বিব্রত। তাই এখনই এ ব্যাপারে বেশি রাজনৈতিক চাপ দিতে চান না তিনি। তবে ভারত এখনও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যে, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে রুশ প্রযুক্তির ওই পরমাণু চুল্লিগুলি গড়ে তোলা হবে।
রুশ-ভারত সম্পর্কের ইতিহাস অনেক পুরনো। ঠান্ডা যুদ্ধের আমল থেকে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে নয়াদিল্লির সম্পর্ক সুবিদিত। এর পর তাসের ঘরের মত ভেঙে গিয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়ন। কিন্তু রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক আজও অটুট। সেই ২০০০ সাল থেকে ফি বছর দ্বিপাক্ষিক বার্ষিক বৈঠকে বসে দু’দেশ। ভারত আজও জোট নিরপেক্ষ বিদেশনীতির মূল সুরটাকেই বহন করে এগোতে চাইছে। বড় দেশ হয়েও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে ভারত কারও কাছেই ‘থ্রেট পারসেপশন’ হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে চায় না। এমনকী পাকিস্তানের সঙ্গেও সংঘাতের পথ এড়াতে আগ্রহী মনমোহন সিংহ। ‘শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু-কৌটিল্য থেকে মাও জে দং -নানা সময়ে নানা রাজনেতা কূটনীতিতে এই মোক্ষম দাওয়াই প্রয়োগ করেছেন বটে। কিন্তু এক জনকে প্যাঁচে ফেলার জন্য প্রতি মুহুর্তে অন্য জনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের অতি সরলীকৃত কূটনীতিকে পরিহার করতেই বেশি আগ্রহী মনমোহন সিংহ। দীর্ঘমেয়াদী বিদেশনীতির অভিজ্ঞতা বলে, আজকের এই বিশ্বায়নের দিনে এই কৌশলে চিঁড়ে ভেজে না। ঠিক এই কারণেই ভারত-চিন-রাশিয়ার পৃথক গোষ্ঠী এখন যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। আবার জি-২০ মতো সংস্থায় অপ্রাসঙ্গিক নয় ভারত। এ এক মজার খেলা। সংঘাত আর সখ্যের এক আশ্চর্যজনক সহাবস্থান।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.