অফিস থেকে বারবার ফোন আসছে। কত হল? বলে যাচ্ছি, ৫৭... ১০২... ১৩৭... ১৪৩...।
যে দিকে যাচ্ছি লাশ। যে দিকে তাকাচ্ছি লাশ। চলতে চলতে হোঁচট খাচ্ছি লাশে। একটা মৃতদেহেও কোনও বিকৃতি নেই। শুধু মৃতের তালিকা লম্বা হয়ে চলেছে। দীর্ঘতর হচ্ছে হাসপাতালে আমার অপেক্ষা।
বিষ-মদে মৃত্যু যে এত ভয়ঙ্কর হতে পারে, বুঝিনি। এর আগে বন্দর এলাকায় বিষ-মদে ২৬ জনের মৃত্যু দেখেছি। কিন্তু এ বারের সঙ্গে তার কোনও তুলনাই হয় না। হাসপাতালের চিকিৎসক-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মী থেকে শুরু করে কর্তব্যরত পুলিশ অফিসারদেরও একটাই কথা, “এত বছর চাকরি করছি। অনেক মৃত্যু দেখেছি। এ তো সব কিছুকে ছাপিয়ে গেল!”
বুধবার বেলার দিক থেকেই রোগী ভর্তি হওয়ার হিড়িক পড়ে গিয়েছিল ডায়মন্ড হারবার মহকুমা হাসপাতালে। তখনও বোঝা যায়নি বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত তা মৃত্যুর মিছিলে পরিণত হবে। শয্যায় জায়গা নেই। রোগীদের ঠাঁই হয়েছে বারান্দায়, মেঝেয়, টেবিলে বা ট্রলিতে। অসুস্থ আর মৃত পাশাপাশি শুয়ে। অসুস্থ জানেনই না, তাঁর পাশের লোকটি মারা গিয়েছে। এক জনকে দেখলাম, মেঝেতে জানলার পাশে রেখে স্যালাইন দেওয়া হচ্ছিল। বসে বসেই মারা গিয়েছেন তিনি।
ঘণ্টায় ঘণ্টায় এত লোক মরছে যে, কে কার আত্মীয়, পরিচয় কী, বোঝার উপায় নেই। প্লেটের উপরে পাঁউরুটি সাজিয়ে রাখার মতো ট্রলির উপরে থাকে থাকে রাখা হচ্ছে মৃতদেহ। এক এক জন করে মারা যাচ্ছে, আর একটা একটা করে দেহ ট্রলিতে তুলে ফেলা হচ্ছে। হাসপাতালের এক কর্মী বললেন, “কী আর করব! কোনও উপায় নেই। এত লাশ নিয়ে যাওয়ার মতো ট্রলি এখানে নেই। হাসপাতাল থেকে মর্গের দূরত্ব প্রায় আধ কিলোমিটার। মাঠ টপকে যেতে হয়। একটা একটা করে লাশ নিয়ে যেতে হলে সারাদিন চলে যাবে। তাই একটা ট্রলিতেই যত বেশি সম্ভব দেহ মর্গে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি।” |
একটা দেহের মাথা যে দিকে রাখা হয়েছে, তার উপরের দেহের মাথা রাখা হচ্ছে উল্টো দিকে। এই ভাবে এক-একটা ট্রলিতে পাঁচ-সাতটা করে দেহ নিয়ে এক জন কর্মীই হাঁফাতে হাঁফাতে ট্রলি ঠেলে নিয়ে যাচ্ছেন মর্গের দিকে। পথে পড়েও যাচ্ছে একটা-দুটো দেহ। আত্মীয়েরা দ্রুত ছুটে এসে লাশ ফের তুলে দিচ্ছেন ট্রলির উপরে। ট্রলির পাশাপাশি ভ্যান রিকশাতেও ঠাসা হয়েছে আরও কিছু দেহ।
হাসপাতাল-বাড়ি পেরিয়ে মাঠে নামতেই নাকে আসছে মর্গ থেকে ভেসে আসা দুর্গন্ধ। ব্লিচিং পাউডার ছড়িয়েও গন্ধ চাপা যাচ্ছে না। ট্রলিতে বা ভ্যানে দেহগুলো এনে কার্যত ছুড়েই ফেলা হচ্ছিল মর্গের সামনে। স্বাস্থ্যকর্মীদের দোষ দেওয়া যায় না। সঙ্গে সঙ্গেই তো ফের তাঁদের হাসপাতালে ছুটতে হচ্ছে, পরের দফার লাশ আনতে। একটার উপরে আর একটা দেহ এসে পড়ছে। দুর্গন্ধ ঠেকাতে দেহগুলোকে কিছুটা ছড়িয়ে ছিটিয়েও রাখার চেষ্টা করেছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। তার মধ্য থেকে নাম মিলিয়ে দেহ খুঁজে বের করা আর এক সমস্যা। সুরতহাল করার জন্য পুলিশ অফিসারেরা এক এক জন মৃতের নাম ডাকছিলেন। সেই লাশ খুঁজে পেতে ঠান্ডার মধ্যেও গলদঘর্ম হচ্ছিলেন ডোমেরা। কোনও লাশ পাওয়া যাচ্ছে পাঁচ-ছ’টি দেহের তলা থেকে। আবার কোনওটা হয়তো ফেলা হয়েছে মর্গের পিছন দিকে। এক ডোমের কথায়, “স্টিকার তো কপালে সাঁটা। সেই কপাল খুঁজে বের করতে প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছে। কারও পা দেখা যাচ্ছে, তো কারও হাত।” ডোমেদের প্রধান উর্মিলা মল্লিক বললেন, “বুধবার থেকে এত লাশ বইছি, যে কিছু মাথায় থাকছে না। মাঝে একবার শুধু খেতে গিয়েছিলাম।”
নামেই মর্গ। এই বিপুল ময়নাতদন্তের পরিকাঠামো তো নেই-ই, গোটা হাসপাতালে কোনও অটোপ্সি-সার্জেনও নেই। মাঠের মধ্যে ছোট্ট একটা ঘর কেবল। ভিতরে ও বাইরে সার দিয়ে লাশ। কিছু প্লাস্টিক দিয়ে ঢাকা। কিছু ত্রিপল বা পুরনো কাপড় দিয়ে। বিছানার চাদরও চোখে পড়ছে। তাতেও আব্রু রক্ষা হচ্ছে না। এত প্লাস্টিক বা ত্রিপল বা কাপড়ই বা কোথায়? অগত্যা অনেক লাশই সার দিয়ে পড়ে আছে বস্ত্রহীন অবস্থায়। |
মৃত্যু খতিয়ান
১৯৯২: ওড়িশায় ২০০-র বেশি
২০০৮: কর্নাটকে ১৮০
২০০৯: গুজরাতে ১৩৬
২০১১: পশ্চিমবঙ্গে ১৪৬ |
|
ঘরের ভিতরে অবস্থা আরও খারাপ। থিকথিক করছে লাশ। দাঁড়ানোর জায়গা নেই। তার মধ্যেই পাশাপাশি তিনটি ট্রলি রেখে বুধবার বিকেল থেকে নাগাড়ে ময়নাতদন্ত করে চলেছেন আলিপুরের এসিএমওএইচ উমাপ্রসন্ন ঘোষাল ও তাঁর দুই সহকারী। ট্রলির চাকা যাতে পিছলে না যায়, তার জন্য বেঁধে রাখা হয়েছে একটার সঙ্গে আর একটাকে। বাইরে গাছতলায় টেবিল পেতে রিপোর্ট লিখছেন উমাপ্রসন্নবাবু। বৃহস্পতিবার রাত ৮টা পর্যন্ত তাঁর টিম ১০২টি ময়নাতদন্ত করে ফেলেছে। উমাপ্রসন্নের কথায়, “এর আগে কাকদ্বীপ গ্রামীণ হাসপাতালেও ট্রলার-ডুবির পরে খুব খারাপ পরিকাঠামোর মধ্যে টানা ১৯ ঘণ্টা ধরে ৫১টা ময়নাতদন্ত করেছিলাম। এখানে ৩০ ঘণ্টা হতে চলল। লাশ আসার বিরাম নেই। একসঙ্গে এত মৃত্যু কখনও দেখিনি।” গাছতলায় বসেই কাগজপত্র ঠিক করতে করতে এক পুলিশ অফিসারও বললেন, “ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা ভাই! আমারও গা গুলোচ্ছে।”
রাত সাড়ে ৯টা। লাশ আসছে এখনও। তবে এ বার একটা-দুটো করে। এখনও শুনছি, হাসপাতালে ভর্তি ৯০ জন। যাঁদের অনেকেই আশঙ্কাজনক।
আবার ফোন অফিস থেকে।
কত হল?
১৪৮...। |