|
|
|
|
আবগারি দফতরের ‘ফাঁকা হুঙ্কার’ই সার |
‘জেডি’র কাটতিতে ভাটা নেই জেলায় |
শুভাশিস সৈয়দ • বহরমপুর |
‘‘জেডি চেনেন?’’ প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিয়ে মলিন পাউচের ঘোলাটে তরল গলায় ঢেলে বাঁকা হাসে রিকশাচালক যুবক। তারপর যোগ করেন, “আরে বাবু জেডি মানে জীবন দান, আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে বাবু, চোলাই!”
এটা যদি প্রথম ছবি হয় তাহলে পরের ছবিটা হল--সাকুল্যে ৪৮ জন কনস্টেবল। যেখানে থাকার কথা ৬৮। ৯ জন ওসি-র জায়গায় রয়েছেন ৫ জন। চোলাই ভাটিতে হানা দেওয়ার জন্য গাড়ির সংখ্যা? নামমাত্র, একটি। অবসর নেওয়ার পরে নতুন করে আর চালক নিয়োগ হয়নি। ফলে রাস্তায় গাড়ি নামাতে চালক ‘ভাড়া’ করতে হয়। ওসি-কনস্টেবল-চালকহীন এমনই ‘নিধিরাম’ মুর্শিদাবাদ জেলা আবগারি দফতরের ‘জেডি’ অভিযানে ভরসা বলতে এটুকুই।
তবে ভাঙলেও মচকাচ্ছে না আবগারি দফতরের জেলা আধিকারিক স্বপনরঞ্জন কাহালি। বলছেন, “মগরাহাটের ঘটনার পরে বেআইনি ভাটি বন্ধে জোরদার অভিযান চালানো হবে, এমন নয়। আমরা তো রোজই ‘রেইড’ করছি। হরিহরপাড়া, বেলডাঙা-১ ও ২ ব্লকের বিভিন্ন জায়গায় বুধবারই হানা দেওয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার অভিযান চালানো হয়েছে জঙ্গিপুর, বহরমপুর, নবগ্রাম থানা এলাকায়। দু’জনকে গ্রেফতারও করা হয়েছে।”
আবগারি দফতরের পরিসংখ্যান, জেলার পাঁচটি মহকুমার মধ্যে বহরমপুর, লালবাগ, জঙ্গিপুর, কান্দিতে সবচেয়ে বেশি চোলাই মদ বিক্রি ও বেআইনি ভাটি চলে। বহরমপুরের হরিদাসমাটি-কৃষ্ণমাটি-বিশ্বনাথপুর-রাঙামাটি চাঁদপাড়া এলাকা। কান্দি মহকুমার বড়ঞা, জঙ্গিপুরের সাগরদিঘি-মণিগ্রাম, লালবাগের এলাহিগঞ্জ। বহরমপুর বাসস্ট্যান্ড, খাগড়া সোনাপট্টি, খাগড়া ও গোরাবাজার শ্মশান এলাকা, নতুনবাজার, মানসিক হাসপাতাল লাগোয়া সব্জি বাজার, কাদাই বাজার। চোলাইয়ের এটাই চেনা ‘সাম্রাজ্য’। কখনও কেমনে প্রমীলা বাহিনির লাঠির ঘায়ে কিছু ভাটি-ভাঙা আর প্রশাসনের কদাচিৎ ‘হুঙ্কার’ ছাড়া চোলাইয়ের এই চেনা জগতে পা পড়েনা কারও। পুলিশ? গ্রাবাসীরা প্রায় এক যোগে জানাচ্ছেন পুলিশের সক্রিয়তা প্রায় শূন্য।
বেআইনি চোলাই মদের বিক্রি কেন বাড়ছে? আবগারি কর্তাদের দাবি, দেশি মদের লাইসেন্স বাড়ানো হচ্ছে না। এ দিকে চাহিদা দেদার। আর সেজন্যই মদ্যপায়ীদের একটা বড় অংশ ঝুঁকছে চোলাইয়ের দিকে। তা কি সত্যি? দেশি মদের ডিলারদের অনেকেই অবশ্য সে কথা মানছেন না। তাঁরা বলছেন, “এটা নেশার ব্যাপার। দামের তেমন ফারাক না থাকলেও যাঁরা চোলাই-এর খদ্দের তাঁরা ওটাই পছন্দ করেন।” আর তাই বোধহয় পাশাপাশি দেশি মদের দোকান আর চোলাইয়ের ভাটিখানা থাকা সত্ত্বেও ভিড়ের ঘাটতি হচ্ছে না সেই বোইনি ভাটিতে।
আবগারি দফতরের হিসেব, দেশি মদ বিক্রি থেকে সরকার প্রতি মাসে মুর্শিদাবাদ জেলা থেকে আড়াই থেকে তিন কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়। দেশি মদ বিক্রির লাইসেন্স দিলে ওই রাজস্বের পরিমাণ আরও বাড়ত। সে ক্ষেত্রে প্রতি বছর বিপুল সংখ্যক রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার।
স্বপনরঞ্জনবাবু বলেন, “বেআইনি ভাবে তৈরি চোলাই মদ কখনও সরকার অনুমোদিত দেশি মদের বিকল্প হতে পারে না। দেশি মদের বোতলের ছিপি সিল করা থাকে। সেই সঙ্গে বিজ্ঞানসম্মত ভাবে কেমিস্টের উপস্থিতিতে অ্যালকোহল মিটারে টেস্ট করে দেশি মদ তৈরি করা হয়। মেশিনের সাহায্যে বোতলগুলিও ভাল ভাবে পরিষ্কার করা হয়।”
কিন্তু, স্থানীয় ভাবে খোলা আকাশের নিচে ভাটিতে তৈরি চোলাই মদ তৈরিতে নিশাদল, ধুতরার বীজ ছাড়াও ছত্রাক মেশানো হয়ে থাকে। এতে অল্প পরিমাণ চোলাই মদ পান করলেই বেশি নেশা হয়। সেই তুলনায় ওই পরিমাণ দেশি মদে নেশা হয় কম। এ দিকে সরকার অনুমোদিত ৬০০ মিলিলিটার দেশি মদের দাম যেখানে ৪৬ টাকা, সেখানে চোলাই মদ অর্ধেক দামে বাজারে বিক্রি হচ্ছে।
আবগারি দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, জেলায় এ বছর জানুয়ারি থেকে ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত ভাটি চালানো ও চোলাই মদ বিক্রির অভিযোগে ২০৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে ৪৩ হাজার ১৪১ লিটার চোলাই মদ। এ ছাড়াও চোলাই মদ তৈরিতে ব্যবহৃত ‘ফার্মান্টেড ওয়াশ’ ২ লক্ষ ৪৩ হাজার ৫৮২ লিটার বাজেয়াপ্ত করে নষ্ট করা হয়েছে।
মুর্শিদাবাদের অতিরিক্ত জেলাশাসক (উন্নয়ন) অজয় ঘোষ বলেন, “আবগারি দফতরের পরিকাঠামোগত উন্নয়ন করা অত্যন্ত জরুরি। তবে সীমিত ক্ষমতার মধ্যেও সপ্তাহের সাত দিনই আবগারি দফতরের কর্মীরা হানা দেওয়ায় চোলাই মদ বিক্রি ও ভাটি বন্ধে আমাদের জেলায় সাফল্যের হার বেশি।”
তাতে কী আত্মতুষ্টির কোনও কারণ আছে? প্রশ্নটা থেকেই যাচ্ছে। |
|
|
|
|
|