|
|
|
|
কাঁকটিয়ায় মিষ্টির দোকানে ‘পলি-চয়েস’ নামে চোলাই |
আনন্দ মণ্ডল • তমলুক |
তামাটে কাচের শো-কেসে খান কয়েক রসগোল্লা, বাসি সন্দেশ আর চমচম ঘিরে মাছির ঝাঁক। দুপুর থেকে ঝিমিয়ে থাকা দোকানির অবশ্য তেমন হেলদোল নেই। সন্ধের মুখে কাঁকটিয়া বাজারের মিষ্টির সেই দোকানটাই ধীরে ধীরে বদলে যেতে থাকে। গ্রামে ফেরা হাটুরে মানুষের ক্রমশ বেড়ে ওঠা আনাগোনা, ‘দু’টো পলি-চয়েস দাও গো!’
কাঁকটিয়া বাজার এখনও ও নামেই চেনে চোলাইয়ের ২০০ মিলিলিটারের পাউচ। অবিকল দু’বছর আগের মতো। মিষ্টির দোকানই নয়, বাজারের আশপাশের ঠান্ডা পানীয়, বৈদ্যুতিন সরঞ্জাম এমনকী ধুপকাঠি, চানাচুর, সস্তার মাজন বোঝাই নিছক মুদির দোকানেও নিচু স্বরে ‘পলি চয়েস’-এর খোঁজ করলে এখনও দেদার মিলছে চোলাই।
দু’বছর আগে বিষ-মদে ৫২ জনের মৃত্যু মিছিলের পরেও পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁকটিয়া এবং রামতারক বাজারের ছবিটা বদলায়নি একটুও। আশপাশের হোগলবেড়িয়া, নোনাকুড়ি, ভিতর আগার, চাধরির মতো গ্রামগুলিতে এখনও দৃষ্টিহীন মানুষের ভিড়। ভাল করে হাঁটতে পারেন না অনেকেই। কিন্তু কাঁটিয়া বা রামতারক এলাকা অবশ্য ‘পলি চয়েস’-এর হাতছানি কাটিয়ে উঠতে পারেনি। |
|
বিষমদ খেয়ে দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন পূর্ব মেদিনীপুর হোগলবেড়িয়া
গ্রামের নন্দ জানা। বৃহস্পতিবার পার্থপ্রতিম দাসের তোলা ছবি। |
২০০৯ সালের ৩ মে ওই দুই বাজার এলাকার ঠেকে সন্ধে-ভর চোলাই খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন শ-দেড়ের গ্রামবাসী। তা বলে চোলাইয়ের বিক্রি বন্ধ হবে? স্থানীয় নোনাকুড়ির বাসিন্দা মধ্য ত্রিশের এক যুবক বলেন, “কমবে কি, বাজারে এখন হেন দোকান নেই যেখানে চোলাই মেলে না। দু’বছর আগের বিষমদ-কাণ্ডের পরেও হুঁশ ফেরেনি মানুষের।” গ্রামের বাসিন্দারা জানান, মাঝে মাঝে আবগারি দফতরের ‘লোক দেখানো’ অভিযান চলছে। কিন্তু ওই ‘লুকোচুরি’ এক সন্ধেতেই শেষ হয়ে যায়। অভিযানের পরের সন্ধেতেই ফের জমে ওঠে পলি-চয়েসের ঠেক। গ্রামের মধ্য বয়সী এক বাসিন্দা বলেন, “বাহিরআগাড় গ্রামে তিনটি চোলাই মদের ঠেক-ই সেই সময় ভেঙে দিয়েছিলেন ক্রুদ্ধ গ্রামবাসীরা। তা সেই ঠেকেই গজিয়ে উঠেছে স্টেশনারি দোকান। প্রকাশ্যে চোলাই মদের ঠেক নেই ঠিকই, কিন্তু মনোহারি দোকানেই পলি-চয়েস চেয়ে দেখুন, দিব্যি মিলবে।”
কাঁকটিয়া বাজারের একটি লাইসেন্সধারী দেশি মদের দোকান রয়েছে। তবে তা সাত তাড়াতাড়ি বন্ধ হয়ে যায়। আশপাশের অন্যান্য দোকান অবশ্য বহু রাতেও খোলা থাকে। আর কিছু না মিলুক সেখানে পলি-চয়েস চাইলেই মিলবে। শুধু তাই নয়, বাজারের অদূরেই কিছু দিন হল নতুন করে গজিয়ে উঠেছে একটি চোলাইয়ের ঠেক। পুলিশ, আবগারি দফতরের জানা নেই? গ্রামবাসীরা জানান, সব জানে। জেনেও ‘চোখ বুজে’ রয়েছে। বল্লুক ১ পঞ্চায়েতের উপপ্রধান তৃণমূলের সরোজ মেটিয়া বলেন, “ওই সব ঠেকে বাংলা মদের নামে এখনও চোলাই বিক্রি হয়। তবে, বাইরের লোকের কাছে সে খবর পৌঁছয় না। পুরোটাই গোপনে চলে।” সাবলআড়া হাটেও চোলাই মদের ঠেক রয়েছে বলে জানান তিনি।
তবে মগরাহাট-কাণ্ডের পরে অবশ্য স্থানীয় মানুষের রোষে পড়েছেন চোলাই কারবারিরা। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় কাঁকটিয়া বাজার এলাকার একটি বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের দোকানে ভাঙচুর চালান তাঁরা। ওই দোকানের পিছনেই চোলাই মদের কারবার চলছিল বলে অভিযোগ। পরে এলাকার মানুষ চোলাই-কারবার বন্ধের দাবিতে হলদিয়া-মেচেদা রাজ্য সড়ক অবরোধও করেন।
রামতারক বাজার লাগোয়া হোগলবেড়িয়া গ্রামেই সে বার মারা গিয়েছিলেন ৮ জন। গ্রামের ৩৩ বছরের যুবক নন্দ জানা এখন আর দেখতে পান না। ঘরের এক কোণে পড়ে থাকেন। হোগলবেড়িয়া গ্রামের ভ্যানচালক মোহন বেরা দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে এখন বেকার। বিষমদ-কাণ্ডেই মারা গিয়েছেন মোহনের দাদা মদন। তাঁদের দেখেও শিক্ষা হয় না? স্থানীয় এক গ্রামবাসী আক্ষেপের সুরে বলেন, “কী বলব দাদা, কাঁকটিয়া আছে কাঁকটিয়াতেই!” |
|
|
|
|
|