মায়ানমারের বিরোধী নেত্রী আঙ সান সু চি’র দল ‘ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রাসি’ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি অর্জন করিয়াছে। রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির পর ইহা দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। সু চি কোনও রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপে অংশ লইবেন না এবং তিনি ও তাঁহার অনুগামীরা নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা হইতেও বিরত থাকিবেন, এই শর্তেই দেশের শাসকরা তাঁহাকে মুক্তি দিয়াছিলেন। সুতরাং, শাসকদের অবস্থানে মৌলিক পরিবর্তন ঘটিয়াছে। সেই পরিবর্তন যে সামরিক একনায়কত্ব হইতে গণতন্ত্রের অভিমুখে, তাহার লক্ষণগুলি ক্রমশ স্পষ্ট হইতেছে। যেমন সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমের উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ উত্তরোত্তর শিথিল করা হইতেছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের অধিকার শিরোধার্য হইলে দেশের ভিতর গণতান্ত্রিক পরিবেশ অনেকাংশে প্রতিষ্ঠিত হয়। মায়ানমারের সমাজ সুদীর্ঘ কাল সেই পরিবেশের স্বাদ পায় নাই।
গণতন্ত্রের পথে এই যাত্রা মসৃণ হইবে, এমন ভরসা কম। সামরিক কর্তাদের ক্ষমতা প্রকৃত চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হইলে তাঁহারা বর্তমান উদারতায় কতটা অবিচল থাকিতে পারেন, তাহা পরীক্ষাসাপেক্ষ। কিন্তু একই সঙ্গে ইহাও সত্য যে, আন্তর্জাতিক একঘরে দশা হইতে মুক্তিলাভ করিতে গেলে মায়ানমারের পক্ষে গণতন্ত্রের অভিমুখী না হইয়া কোনও উপায় নাই। শাসকরা নিশ্চয় সে কথা উপলব্ধিও করিয়াছেন। স্বৈরশাসনের বজ্রআঁটুনি সামান্য শিথিল করিতেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রতিবেশীরা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত যে-ভাবে সহযোগিতার পসরা সাজাইয়া দরজায় হাজির হইতেছে, তাহা নিশ্চয় শাসকদের প্রভাবিত করিবে। যে দেশকে সে-দিন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক মঞ্চে অচ্ছুৎ রাখা হইয়াছিল, ২০১৪ সালে তাহাকেই ‘আসিয়ান’-এর শীর্ষ সম্মেলন আয়োজনের দায়িত্ব অর্পণ করা হইয়াছে। মার্কিন বিদেশ মন্ত্রী হিলারি ক্লিন্টন ইয়াঙ্গনে আসিয়া আশ্বাস দিয়াছেন, গণতান্ত্রিক সংস্কারের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করিলে মার্কিন সহযোগিতার ঝাঁপি মায়ানমারের সামনে উন্মুক্ত করিয়া দেওয়া হইবে। সু চি-ও আমেরিকা সহ বিভিন্ন দেশকে শাসকদের হইয়া সহযোগিতার অনুরোধ জানাইতেছেন।
এত দিন চিন ছাড়া মায়ানমারের কোনও সাহায্যকারী ছিল না। এই বৃহৎশক্তির কাছেই তাহাকে যাবতীয় সাহায্যের জন্য হাত পাতিতে হইয়াছে। বিনিময়ে তৈলক্ষেত্রের বিপুল সম্পদের ভাগও বেজিংয়ের কর্তাদের দিতে হইয়াছে। এখন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য প্রতিবেশী এবং স্বয়ং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আগাইয়া আসিলে দেশের উন্নয়নের জন্য পুঁজি ও প্রযুক্তি বিনিয়োগের ক্ষেত্রটিতে একা চিনের আধিপত্য ঘুচিবে। দেশের ভিতর গণতান্ত্রিক সংস্কারের প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার উপর সেই উত্তরণ অনেকটা নির্ভরশীল। ভারতের মতো নির্ভরযোগ্য প্রতিবেশীর কাছ হইতেও মায়ানমার বেজিংকে ঠেকাইবার শক্তি পাইবে। নয়াদিল্লির ‘পুবের দিকে তাকাইবার’ বিদেশ নীতি সাম্প্রতিক কালে ইয়াঙ্গনের শাসকদের সহিত রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতা এবং আর্থ-বাণিজ্যিক সহযোগিতার বহুমুখী সম্ভাবনা মুক্ত করিয়াছে। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কেও প্রবাহিত হইতেছে মৈত্রীর সুপবন। মায়ানমারকে গণতান্ত্রিক সংস্কারের পথে আগাইয়া দিতেও নয়াদিল্লি তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা লইতে পারে। কেবল চাই ইয়াঙ্গনের নিরবচ্ছিন্ন সদিচ্ছা। |