দুর্যোধন বিনা যুদ্ধে সূচ্যগ্র ভূমি ছাড়িতে রাজি ছিলেন না। পরিণাম কুরুক্ষেত্র। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জমি না-ছাড়িবার ধনুর্ভঙ্গ পণ করিয়া ভোটযুদ্ধে লড়িয়াছেন এবং জয়ী হইয়াছেন। পরিণাম স্থিতাবস্থা। জমির ঊর্ধ্বসীমা সংক্রান্ত আইনের স্থিতাবস্থা। প্রকৃতপক্ষে, অচলাবস্থা। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানাইয়া দিয়াছেন, শহরে জমির মালিকানার যে ঊর্ধ্বসীমা আইনে নির্দিষ্ট আছে, তাহা বদলাইবে না, আইন সংশোধনের অভিপ্রায় তাঁহার নাই। আইন সংশোধনের প্রয়োজন কেন? এই কারণে যে, বহু প্রকল্প তৈয়ারি করিতে যথেষ্ট জমির দরকার হয়, অথচ ঊর্ধ্বসীমা আইনের কারণে বিনিয়োগকারী সেই পরিমাণ জমি কিনিতে পারেন না। এই আইন কার্যক্ষেত্রে বিনিয়োগের পথে বাধা হইয়া দাঁড়ায়। এই কারণেই ১৯৯৯ সালে, ভারতের আর্থিক সংস্কারের প্রক্রিয়ায়, কেন্দ্রীয় সরকার জমির ঊর্ধ্বসীমা সংক্রান্ত জাতীয় আইনটি সংশোধন করিয়াছিল। তাহার অনুসরণে বিভিন্ন রাজ্যে ক্রমশ আইন সংশোধন হইতে থাকে। পশ্চিমবঙ্গ এখনও তাহার পুরানো আইনেই অচল। এখনও শহরে কেহ সাড়ে সাত কাঠার অধিক জমির মালিকানা লইতে পারেন না। তাহার পরিণাম পশ্চিমবঙ্গের পক্ষে শুভ হয় নাই। এই রাজ্যে বিনিয়োগের মন্দা দীর্ঘ দিনের। তাহার অনেক কারণ আছে, কিন্তু জমির অভাব একটি বড় কারণ। সিঙ্গুরের কাহিনি অত্যন্ত জটিল এবং বহুমাত্রিক, কিন্তু তাহার মূলে রহিয়াছে শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় জমি সংগ্রহ করিবার ক্ষেত্রে এই মৌলিক সমস্যা। কেবল শহরে নয়, অন্যত্রও জমির ঊর্ধ্বসীমা নিতান্ত কম, ফলে পশ্চিমবঙ্গে জমির মালিকানা অতিখণ্ডিত। তাহা হইতে দুই রকমের সমস্যার উদ্ভব হয়। এক, পর্যাপ্ত জমি কিনিবার জন্য বহু সম্ভাব্য এবং ইচ্ছুক বিক্রেতার প্রয়োজন হয়। দুই, সেই প্রয়োজন পূর্ণ হইলেও যথেষ্ট জমি কেনা যায় না, ঊর্ধ্বসীমায় মাথা ঠেকিয়া যায়। এই কারণেই ঊর্ধ্বসীমা আইন সংশোধন জরুরি।
কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী তাহা মানিতে রাজি নহেন। তাঁহার বক্তব্য, ‘প্রকৃত শিল্প’র জন্য জমির ব্যবস্থা তিনি করিয়া দিবেন। উদাহরণস্বরূপ তিনি শালবনিতে ইস্পাত প্রকল্পের কথা বলিয়াছেন। সত্য, সেই প্রকল্পের জন্য আবশ্যক জমির এক ধরনের ব্যবস্থা তিনি করিয়া দিয়াছেন। প্রয়োজনীয় জমি সরকারের হাতে লইয়া সেই জমি শিল্পসংস্থাকে দীর্ঘমেয়াদি লিজ হিসাবে দিয়া আশু সমস্যার সমাধান হইয়াছে। কিন্তু তিব্বত যাইতে হইলে ডায়মন্ড হারবার রানাঘাট ঘুরিবার সত্যই কোনও প্রয়োজন আছে কি? মুখ্যমন্ত্রী নিজেই উচ্চরবে ঘোষণা করিয়া থাকেন যে তিনি জমির সরকারি অধিগ্রহণের বিরোধী। অথচ তিনি আইনের সংশোধন করিবেন না, ফলে বেসরকারি উদ্যোগী জমি কিনিতে চাহিলে ঊর্ধ্বসীমায় বাধা পাইবেন। তাহা হইলে বিনিয়োগকারী পশ্চিমবঙ্গে আসিবেন কেন? বিশেষত, অন্যান্য রাজ্যে যখন ঊর্ধ্বসীমার বালাই কার্যত অন্তর্হিত হইয়াছে? মুখ্যমন্ত্রী বলিতেছেন, শিল্পের নাম করিয়া জমি লইবার পরে অন্য উদ্দেশ্যে তাহা ব্যবহার করা বা নিছক ফেলিয়া রাখা অন্যায়, তাহা তিনি বরদাস্ত করিবেন না। অবশ্যই তাহা অন্যায়, সুতরাং বরদাস্ত করা উচিত নয়। কিন্তু সেই অন্যায় নিবারণের যোগ্য বন্দোবস্ত করা কঠিন কিছু নহে। প্রথমত, সংশোধিত আইনে জমির যথাযথ ব্যবহারের অনুশাসন রাখা দরকার এবং দ্বিতীয়ত, সেই অনুশাসন অমান্য করিলে দ্রুত এবং কঠোর প্রতিবিধান দরকার। এক কথায়, প্রয়োজন যথাযথ আইন এবং তৎপর প্রশাসন। তাহা তো সাধারণ ভাবেও জরুরি। জমির বাজার অন্যান্য পণ্যের বাজার হইতে স্বতন্ত্র চরিত্রের, তাহার অপব্যবহার নিবারণের জন্য বিশেষ রক্ষাকবচ এবং তদারকি সব দেশেই আছে। কিন্তু জমির বাজারটিকেই অচল করিয়া রাখিলে পশ্চিমবঙ্গ অগ্রসর হইবে কী রূপে? মুখ্যমন্ত্রী প্রয়োজনে আত্মসংশোধনে পিছপা নহেন। বন্ধ, অবরোধ ইত্যাদি প্রশ্নে তাঁহার অবস্থান পরিবর্তিত হইয়াছে। জমির প্রশ্নেই বা সূচ্যগ্র জমি না ছাড়িবার পণ কেন? |