সবসময় যেন চোখের সামনে ভাসছে, আমাদের গাড়িটা কী ভাবে উল্টে গেল। গাড়ি থেকে ছিটকে বেরিয়ে গেলাম। গাড়িটা গড়িয়ে পড়ল নীচে। একটা পাথরের খাঁজে গিয়ে পড়েছিলাম। সেখানেই কাটাতে হল সারাটা রাত। রাত যেন কাটতেই চাইছিল না।
মঙ্গলবার গাড়ি নিয়ে ইয়ুমথাং থেকে আমরা ফিরছিলাম গ্যাংটকে। আমি, বাবা-মা ও দাদা। সঙ্গে আরও কয়েকজন।
|
সোহম সরকার |
গ্যাংটকে কয়েকটা দিন থেকে ১৭ ডিসেম্বর সোনারপুরে ফেরার ট্রেন ধরার কথা। ওই দিন বাবা শুরু থেকেই একটু চিন্তায় ছিলেন। একটা থানায় পুলিশ গাড়িটিকে আটকায়। চালকের বিরুদ্ধে হয়তো কোনও অভিযোগ ছিল। পুলিশ তাঁর সঙ্গে কথা বলছিল। সেখান থেকে ছাড়া পেয়ে কোথায় যেন তিনি চলে যান। যখন ফেরেন, তখন তিনি আর আগের মতো নেই। কেমন যেন টলছিলেন। গাড়িও ঠিক মতো চালাচ্ছিলেন না। গাড়ির লোকেরা তাঁকে বারবার বলছিলেন, ঠিক করে গাড়ি চালান। আমি এর পর ঘুমিয়ে পড়ি। খাদে গাড়িটা পড়ার মুখে ঝাঁকুনিতে জেগে উঠি।
আবছা অন্ধকারে পাহাড়ের ঢালে আটকে কখনও ভগবানকে ডাকছি। দাদা (শৌভিক সরকার), বাবা (অসিত সরকার), মা (মীনা সরকার) কে কোথায় রয়েছে অন্ধকারের মধ্যেই বোঝার চেষ্টা করি। খুবই অল্প আলো পাহাড়ের ঢালে। কোথা থেকে সেই আলো এসেছে বলতে পারব না। তবে পরিষ্কার কিছুই বোঝাই যাচ্ছিল না।
এক সময় মাথার উপর থেকে একজন গড়িয়ে পড়ল কাছাকাছি। গলার স্বরে বুঝতে পারলাম মা। মা-ও আমাকে বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু তারপরেই মা গড়িয়ে আরও কিছুটা নীচে নেমে গেল। এক সময় গলার আওয়াজে বুঝলাম, বাবা (অসিত সরকার) আমার মাথার উপরে রয়েছে। আমাকে বলল, ‘বেশি নড়াচড়া করিস না। শান্ত হয়ে বসে থাক। ভয় পাবি না।’ বাবার কথায় বুকে একটু বল এল। পরে বুঝেছি, নীচের দিকে অনেকটা দূরে দাদাও রয়েছে।
ওই অবস্থায় অন্ধকারের মধ্যেই নীচে নদীর জলের আওয়াজ পাচ্ছিলাম। জন্তুর ডাকও কানে এল। আমি ভাগবানকে ডাকছি। মাঝে মাঝে ঘুম আসছে। কখনও বাবা সাবধান করছে, বেশি নড়াচড়া না করতে। জেগে থাকতে। ভয় না পেতে। এক সময় ভোর হল। বাবা তার মধ্যে মোবাইল থেকে কোথাও ফোন করেছে। লোকজন এসে একে একে বাবাকে আর আমাকে উদ্ধার করল। হাসপাতালে নিয়ে গেলেন ওঁরা। গাড়িতে যাঁরা ছিলেন অনেকে মারা গিয়েছেন। বাবা, দাদাকে কাছে পেলাম। মা-কে আর দেখতে পাইনি।
|
(সোহম সারদা বিদ্যাপীঠের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র) |