সিঁড়ির তলায় মিটার বক্সের মধ্যে রাখা অতিদাহ্য স্পিরিটের জার। রাখা আছে ঝাঁটা। জমে রয়েছে আবর্জনা। বেশিরভাগেরই ফায়ার লাইসেন্স নেই। নেই নার্সিহোমে রোগী দেখার জন্য চিকিযসকদের ‘প্র্যাকটিস লাইসেন্স’ও। ৫ থেকে ২০ শয্যার অনুমতি থাকলেও উপযুক্ত পরিকাঠামোর ব্যবস্থা না করেই আরও শয্যা বাড়ানো হয়েছে। বিদ্যুতের অবস্থাও বেহাল। অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র রয়েছে। কিন্তু তা খারাপ। নেই সেই সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় কাগজপত্র। উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাটে বসিরহাট মহকুমা হাসপাতাল এবং বেশ কিছু নার্সিংহোম ঘুরে মঙ্গলবার এমন সব দৃশ্যই চোখে পড়ল এই প্রতিবেদকের। চিকিৎসার জন্য নিরুপায় রোগী যেখানে ছুটে আসেন সেখানকার এমন হাল দেখে স্বাভাবিক ভাবেই আতঙ্ক জাগে। বিশেষত কলকাতায় আমরি হাসপাতালে ভয়ঙ্কর অগ্নিকাণ্ডের পরে।
এ দিন মহকুমা হাসপাতাল-সহ বিভিন্ন চিকিৎসা কেন্দ্রের এমন হাল দেখে ক্ষুব্ধ বসিরহাটের পুরপ্রধান একটি নার্সিংহোম বন্ধ করার নিদের্শ দেন। এ ছাড়া বেশ কিছু নার্সিংহোম কর্তৃপক্ষকে সাত দিনের মধ্যে সমস্ত ব্যবস্থা ঠিক করার নির্দেশ দিয়েছেন।
|
বসিরহাট হাসপাতাল চত্বরে সাফ করা হচ্ছে জঞ্জাল। |
বসিরহাট মহকুমায় নাসির্ংহোমের সংখ্যা ৫০ থেকে ৬০টি। এ ছাড়া বেশ কিছু সরকারি হাসপাতাল রয়েছে। কলকাতার আমরি হাসপাতালে দুর্ঘটনার প্রেক্ষিতে সোমবার বিকেলে পুরপ্রধানের নেতৃত্বে বিদ্যুৎ দফতর ও দমকল বিভাগের তিন আধিকারিককে নিয়ে বিভিন্ন সরকারি হাসপাতাল ও নার্সিংহোমে অভিযান শুরু হয়। মঙ্গলবারও সেই অভিযান অব্যাহত ছিল। অভিযানের সূত্রেই এ দিন বসিরহাট মহকুমা হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেল, হাসপাতালে আগুন লাগলে তা নেভানোর জন্য আটটি অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র রয়েছে। যদিও দেখা গিয়েছে, সেগুলির সবকটিই অকেজো নয়তো মেয়াদ উত্তীর্ণ। স্বাভাবিক বিদ্যুৎ ব্যবস্থা থেকে জেনারেটর সংযোগের জন্য কোনও অটোচেঞ্জার নেই। কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে বা জরুরি প্রয়োজনে যাতে অটোমেটিক বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হতে পারে সে জন্য জরুরি মেন সুইচ নেই। একই জায়গায় গাদাগাদি করে রাখা অক্সিজেন সিলিন্ডার, অতিদ্যহ্য স্পিরিটের জার। হাসপাতালের যত্রতত্র জমে রয়েছে আবর্জনা। পরিস্থিতি দেখে ক্ষুব্ধ প্রতিনিধিদল অবিলম্বে এ ব্যাপারে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে এবং আবর্জনা পরিষ্কারের জন্য কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন। হাসপাতালের সুপার রঞ্জিত দাসও এই সব সমস্যার অবিলম্বে সমাধান করা হবে বলে প্রতিনিধিদলকে জানান।
এ দিন পুরপ্রধান কৃষ্ণা মজুমদার, দমকল বিভাগের মহকুমা দফতরের ওসি রঞ্জিত মণ্ডল ও বিদ্যুৎ দফতরের স্টেশন ম্যানেজার সুজিত গোলদার-সহ অন্য আধিকারিকেরা বসিরহাট হাসপাতাল লাগোয়া উদয়ন নার্সিংহোমে যান। সিঁড়ির তলায় জমে থাকা আবর্জনা সরানোর নির্দেশ দিয়ে সেখানকার দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসক পরিমল রায়ের কাছে নার্সিংহোমে কত শয্যার অনুমোদন রয়েছে তা জানতে চান। ৫টি শয্যার অনুমোদন থাকলেও বর্তমানে সেখানে ২৪টি শয্যা আছে জানতে পেরে পুরপ্রধান তাঁকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে দেখা করতে বলেন। বিদ্যুৎ দফতরের পক্ষ থেকেও প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেওয়া হয়।
এখান থেকে বেরিয়ে প্রতিনিধিদলটি যান সানরাইজ নার্সিংহোমে। সেখানে সিঁড়ির তলায় মিটারের জায়গায় অতিদাহ্য স্পিরিটের জার রাখা আছে দেখে চমকে ওঠেন প্রতিনিধিদলটি। দ্রুত সেগুলিকে অন্যত্র সরিয়ে ফেলার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়।
|
নার্সিংহোম পরিদর্শনে পুরপ্রধান। |
সুজিতবাবু বলেন, “সর্বত্রই বিদ্যুৎ ব্যবস্থার মধ্যে গলদ দেখা গিয়েছে। বহু ক্ষেত্রে আলাদা মিটারের ব্যবস্থা না করে বাড়ির মিটার থেকে নার্সিংহোম চালানো হচ্ছে। উপযুক্ত ওয়্যারিং পর্যন্ত নেই। এটা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। ওই সব নার্সিংহোম কতৃর্পক্ষকে বলা হয়েছে আগামী সাতদিনের মধ্যে ব্যবস্থা না নিলে বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হবে।” নার্সিংহোমে ১৫টি শয্যা আছে বলে দাবি করা হলেও দেখা যায় ৩৪টি শয্যা রয়েছে। অপরিসর সিঁড়ি। দুর্ঘটনা ঘটলে বেরোবার জন্য দ্বিতীয় কোনও পথ নেই। নেই দমকল বিভাগের ছাড়পত্র। ক্ষুব্ধ পুরপ্রধান অবিলম্বে নার্সিংহোম বন্ধ করার নির্দেশ দেন।
স্বর্ণকমল, সেবা, সোম মেডিক্যাল সেন্টার এমন বহু নার্সিংহোমেই প্রায় একই অবস্থা দেখা গিয়েছে। পুরসভার লাইসেন্স বিভাগের অফিসার প্রতাপ রায়চৌধুরী বলেন, “৬ মাস আগে এলাকার ১২টি নার্সিংহোম কর্তৃপক্ষকে বলা হয়েছে সেখানে প্র্যাকটিস করা চিকিৎসকেরা যেন পুরসভার লাইসেন্স নেন। কিন্তু কোনও ক্ষেত্রেই সেই নিদের্শ মানা হয়নি।”
পুরপ্রধান কৃষ্ণা মজুমদার বলেন, “এত বড় একটা দুর্ঘটনার পরেও কারও চৈতন্য হয়নি। সানরাইজ নার্সিংহোমটি যেন জতুগৃহ। কারও ফায়ার লাইসেন্স নেই তো কারও পুরসভার লাইসেন্স নেই। সমস্ত নার্সিংহোমকে রোগীদের নিরাপত্তার স্বার্থে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। অন্যথায় কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
নির্দেশ পাওয়ার পরে হাসপাতাল বা নার্সিংহোমগুলি সেগুলি যথাযথভাবে পালন করছে কি না তা নজর রাখতে নিয়মতি অভিযান চালানো হবে বলে পুরপ্রধান জানিয়েছেন।
|