আমরি অগ্নিকাণ্ডে সোমবার গভীর রাতে আরও দু’জনকে গ্রেফতার করল কলকাতা গোয়েন্দা পুলিশ। তাঁরা হলেন, হাসপাতালের চেয়ারম্যান (সেফটি) সত্যব্রত উপাধ্যায় এবং এজিএম (রক্ষণাবেক্ষণ) সঞ্জীব পাল। মঙ্গলবার তাঁদের আলিপুর আদালতে হাজির করানো হলে মুখ্য বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট চৌধুরী হেফাজত করিম ১০ দিন পুলিশ হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন। এর আগে সংস্থার সাত ডিরেক্টরকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। এই নিয়ে ওই ঘটনায় ন’জনকে গ্রেফতার করল পুলিশ।
তদন্তকারী অফিসারেরা জানিয়েছেন, সত্যব্রতবাবু হাসপাতালের নিরাপত্তার দিকটি দেখতেন। তদন্তকারীদের দাবি, আগুন লাগার পরে নিরাপত্তাকর্মীরা তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। তিনি তা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিলেন। এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে তদন্তের স্বার্থে সত্যব্রতবাবু এবং সংস্থার ডিরেক্টরদের মোবাইলের ‘কল লিস্ট’ যাচাই করা হবে বলে জানিয়েছেন তদন্তকারীরা। আগুনের খবর পাওয়ার পরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কার কেমন ভূমিকা ছিল, তা-ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। বস্তুত, এ দিন আদালতে সরকার পক্ষের আইনজীবী বলেন, পরিচালন সমিতির যে কর্তাদের আগেই ধরা হয়েছে, তাঁরা দাবি করেছেন, নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়টি এই দু’জনই দেখভাল করতেন। ওঁরা তাই কিছুই জানেন না। তদন্তে পুলিশ জেনেছে, সঞ্জীববাবু সেপ্টেম্বর মাসে হলফনামায় সই করে দমকলকে বলেছিলেন, তিন মাসের মধ্যে বেসমেন্ট ফাঁকা করে দেওয়া হবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। বেসমেন্টে রাখা জিনিসপত্র থেকেই আগুন লেগেছিল সে দিন। অর্থাৎ, গোটা ঘটনায় তিনি তাঁর দায়িত্ব এড়াতে পারে না বলেই মনে করছেন গোয়েন্দারা। |
আলিপুর আদালতে সত্যব্রত উপাধ্যায় (বাঁ দিকে) ও সঞ্জীব পাল। নিজস্ব চিত্র |
যে সাত কর্তাকে আগেই ধরা হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে এক জন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে। কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা প্রধান দময়ন্তী সেন বলেন, “আমরি-র পরিচালন সমিতির এক সদস্য রাধেশ্যাম অগ্রবাল একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি আছেন। হাসপাতালের কাছে জানতে চেয়েছি, তিনি এখন কেমন আছেন। রিপোর্ট পেলে তাঁকেও হেফাজতে নিতে আবেদন জানাব। সে ক্ষেত্রে কোনও সরকারি হাসপাতালে রাখা হবে তাঁকে।” গোয়েন্দা প্রধানের বক্তব্য, হাসপাতালের পরিচালন সমিতিতে ১২-১৩ জনের নাম থাকলেও সকলের সিদ্ধান্তকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হত না। ওই সমিতিতে যে সরকারি প্রতিনিধি আছেন, তাঁর কাছেও সবিস্তার জানতে চাওয়া হবে।
পুলিশ সূত্রের খবর, সে রাতে হাসপাতালের নিরাপত্তার দায়িত্বে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছ’জনকে এ দিন জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তাঁদের জবানবন্দি রেকর্ড করে রাখা হয়েছে। আরও বেশ ক’জনকে জেরা করা হবে। তদন্তকারী অফিসারেরা বলেছেন, প্রাথমিক ভাবে জানা গিয়েছে, আগুন লাগার পরে নিরাপত্তাকর্মীদের কয়েক জন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে বিস্তারিত জানিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁদের নিজেদের মতো করে আগুন নেভানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। একই সঙ্গে নির্দেশ ছিল, বাইরের লোক যাতে কোনও মতেই হাসপাতালে ঢুকতে না পারে। তাই আগুন লাগার পরে নিরাপত্তাকর্মীরা মূল গেটে তালা লাগিয়ে দিয়েছিলেন।
গোয়েন্দা প্রধান বলেন, “চার মাস আগেও ওই হাসপাতালে ছোটখাটো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল। সেটা জানাজানি হয়নি। নিরাপত্তাকর্মীদের জিজ্ঞাসাবাদ করে এখন জানা গিয়েছে। সেই ঘটনারও তদন্ত চলছে।” পুলিশ জেনেছে, নিরাপত্তাকর্মীরা গত বৃহস্পতিবার রাতে শুধু রোগীর আত্মীয়-স্বজনকেই ভিতরে ঢুকতে বাধা দিয়েছিলেন তা নয়, তীব্র গন্ধে প্রাণ বাঁচাতে বেশ ক’জন রোগী হাসপাতালের বাইরে বেরোতে চাইলেও তাঁরা সেই অনুমতি দেননি। উল্টে ‘এমন কিছু হয়নি’ বলে তাঁদের নিজেদের বিছানায় চলে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন ওই নিরাপত্তাকর্মীরা।
পুলিশ জানায়, সে রাতে আগুন লাগার খবর কে, কখন, কী ভাবে হাসপাতালের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিলেন, তা যাচাই করতে ধৃতদের একক ভাবে বা মুখোমুখি বসিয়ে জেরা করা হবে। গোয়েন্দা প্রধান বলেন, যাঁরা বেঁচে গিয়েছেন তাঁদের সঙ্গেও কথা বলেছে পুলিশ। কখন তাঁরা পোড়া গন্ধ পেয়েছিলেন, তা জানতে চাইছেন তদন্তকারী অফিসারেরা।
পুলিশ জেনেছে, বেসমেন্টে প্রচুর পরিমাণে তুলো ও কাপড় মজুত ছিল। সেখানেই প্রথম আগুন লাগে বলে প্রাথমিক তদন্তে জানা গিয়েছে। গোয়েন্দা প্রধান জানান, ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞদের চূড়ান্ত রিপোর্ট পেলেই আগুন লাগার মূল কারণ জানা যাবে। একই সঙ্গে শর্ট সার্কিটের আশঙ্কাও উড়িয়ে দিচ্ছে না পুলিশ। গোয়েন্দা প্রধান বলেন, হাসপাতালের স্প্রিঙ্কলার ও স্মোক অ্যালার্ম বা বিপদঘন্টি বন্ধ ছিল। আগুন নেভানোর জন্য যে প্রশিক্ষণ প্রয়োজন তা কর্মীদের ছিল না। আগুন লেগে গোটা ইলেকট্রিকাল প্যানেলটাই পুড়ে গিয়েছিল। গোটা হাসপাতাল অন্ধকার হয়ে যায়। বাতানুকূল ব্যবস্থাও অকেজো হয়ে পড়ে। |