অগ্নিকাণ্ডের চার দিনের মধ্যে ফের গোলমাল হল ঢাকুরিয়ার আমরি-চত্বরে। যার জেরে মঙ্গলবার ওই হাসপাতালের মূল ভবনেও (অগ্নিকাণ্ড হয়েছিল অ্যানেক্স ভবনে) পরিষেবা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেল। সেখানে সাত জন গুরুতর অসুস্থ রোগী-সহ মোট ১৩ জন ভর্তি ছিলেন। ‘নিরাপত্তার অভাব’ বোধ করায় তাঁদের আমরির অন্য হাসপাতালে সরিয়ে সন্ধ্যায় ঢাকুরিয়ার হাসপাতাল বন্ধ করে দেন কর্তৃপক্ষ। হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স ও কর্মীদেরও ভাগাভাগি করে আমরির অন্য হাসপাতালে পরিষেবায় নিযুক্ত করা হবে বলে তাঁরা জানিয়েছেন।
তবে একই সঙ্গে কর্তৃপক্ষের তরফে জানানো হয়, ওই সিদ্ধান্ত ‘সাময়িক’। পরিস্থিতি বিবেচনা করে তাঁরা পরবর্তী পদক্ষেপ করবেন।
এ দিনই দুপুরে মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য বলেছিলেন, “আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ওখানে আর নতুন করে কোনও রোগী ভর্তি করানো হবে না। বিভিন্ন তদন্তের স্বার্থেই ওই সিদ্ধান্ত।”
ঘটনাচক্রে, এ দিনই আমরি কর্তৃপক্ষের তরফে এক বিবৃতিতে হাসপাতালের সমস্ত কর্মীদের ‘ধন্যবাদ’ জানিয়ে বলা হয়েছিল, অগ্নিকাণ্ডের সময় তাঁরা নিজেদের জীবন বিপন্ন করে রোগীদের বাঁচিয়েছেন। রোগীদের বাঁচাতে গিয়ে কেরলের যে দু’জন নার্সের মৃত্যু হয়েছে, তাঁদের পরিবারের প্রতিও শোকজ্ঞাপন করা হয়েছিল। হাসপাতালের তরফে কর্মীদের কাছে আবেদন জানিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, হাসপাতালের এই সঙ্কটের সময়ে তাঁরা যেন আগের মতোই কাজ চালিয়ে যান। কর্মীদের বেতন-সহ বিভিন্ন প্রাপ্য নিয়েও কোনও ‘অনিশ্চয়তা’ নেই বলেই বিবৃতিতে জানানো হয়েছিল। |
গণ্ডগোলের পর আমরি থেকে দল বেঁধে বেরোচ্ছেন নার্সরা। নিজস্ব চিত্র |
পরে ‘পরিবর্তিত’ পরিস্থিতিতে হাসপাতাল পুরোপুরিই বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে হাসপাতাল সূত্রে খবর।
ঘটনার সূত্রপাত এ দিন বেলা সাড়ে ১১ টা নাগাদ। তার কিছুক্ষণ আগে আচমকাই হাসপাতালে আসেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। হাসপাতাল-কর্মীদের একাংশ তাঁকে ঘিরে ধরে বিক্ষোভ দেখায়। তার পরেই ক্ষুব্ধ হাসপাতাল কর্মীদের ঘণ্টাখানেক ঢাকুরিয়া ব্রিজ অবরোধ, অবরোধকারীদের হঠাতে পুলিশের বদলে পাশের পঞ্চাননতলা বস্তির একাংশ থেকে মারমুখী জনতার হামলা হয়। নীরব দর্শকের ভূমিকায় থাকা পুলিশের সামনেই মারপিট, ভাঙচুর চলে। আতঙ্কও ছড়ায়। যার জেরে মূল ভবনও বন্ধ করে রোগীদের আমরির অন্য হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। প্রসঙ্গত, অগ্নিকাণ্ডে অসুস্থদের দেখতে এ দিন সন্ধ্যায় সল্টলেক আমরিতে যান রাজ্যপাল এম কে নারায়ণন। হাসপাতালে প্রায় আধ ঘণ্টা কাটিয়ে বেরিয়ে রাজ্যপাল বলেন, “ঘটনার দিন শহরে ছিলম না। সে দিন যাঁরা ওখানে (ঢাকুরিয়া) ছিলেন, তাঁদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।” রাজ্যপাল জানান, রোগীদের কেউ কেউ তাঁর কাছে চিকিৎসক-নার্সদের প্রশংসা করেছেন।
অন্যদিকে, ঢাকুরিয়া আমরির পরিষেবা সরেজমিনে দেখতে এ দিন বেলা সওয়া ১১ টা নাগাদ সেখানে হাজির হন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি সোজা চলে যান আইটিইউতে। হাসপাতাল সূত্রের খবর, মুখ্যমন্ত্রী সেখানে দেবমিত্র নামে কোনও রোগী ভর্তি আছেন কিনা জানতে চান। হাসপাতাল কর্মীরা তালিকা দেখে বলেন, দেবব্রত মিত্র নামে এক জন ভর্তি ছিলেন। অগ্নিকাণ্ডের পর তাঁকে মুকুন্দপুর আমরিতে পাঠানো হয়েছিল। সেখান থেকে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। বাকি রোগীদের খোঁজ নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী যখন নীচে নেমে আসছেন তখন সিঁড়িতেই হাসপাতালের কয়েকজন মহিলা তাঁর কাছে চাকরির নিরাপত্তা সংক্রান্ত ‘আশ্বাস’ চান। তখনই সমস্যার সূত্রপাত।
হাসপাতাল সূত্রের খবর, ইন্দ্রাণী রামানি নামে এক ওয়ার্ড অ্যাসিস্ট্যান্ট মুখ্যমন্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করেন, তাঁদের কী হবে? চাকরি চলে গেলে তাঁরা কী খাবেন। সেই প্রশ্নে মুখ্যমন্ত্রী উত্তেজিত হন বলে অভিযোগ। ইন্দ্রাণী পরে বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী বলেন, আমি অন্যরকম মানুষ। তোমাদের ম্যানেজমেন্ট মানুষ খুন করেছে আর তোমরা তাদের হয়ে কথা বলছ! এত মানুষ মারা গিয়েছে! তোমাদের আবার চাকরি কীসের। যা দেখার, তোমাদের ম্যানেজমেন্ট দেখবে!’’ হাসপাতাল থেকে গাড়িতে ওঠার আগেও মুখ্যমন্ত্রীকে বলতে শোনা যায়, “আমি একজন নিখোঁজের খোঁজ করতে এসেছিলাম। তাঁর খোঁজ পেয়ে গিয়েছি।” একইসঙ্গে তিনি বলেন, “এই হাসপাতালে এত লোকের মৃত্যু হয়েছে! আগে তার বিচার হবে! সমস্ত কর্মীরা দোষী বলে আমি মনে করি না। আমি তো চাই, সকলেই ভাল থাকুক। কিন্তু কর্মীদের দিকটা তো ম্যানেজমেন্ট দেখবে!”
কর্মীদের একাংশের অভিযোগ, হাসপাতালে মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের সঙ্গে ‘সঠিক’ ব্যবহার করেননি। পক্ষান্তরে, মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ মহলের বক্তব্য, ‘পরিকল্পিত ভাবে’ মুখ্যমন্ত্রীকে ঘিরে বিক্ষোভ দেখানো হয়েছে। তিনি যে হাসপাতালে আসছেন, তা পুলিশ মারফৎ আগে থেকে জানতে পেরেই ওই ‘পরিকল্পিত’ বিক্ষোভ। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কর্মীদের একাংশ ‘অভব্যতা’ করেন বলেও প্রশাসনের একাংশের দাবি। যা ‘অনভিপ্রেত’। তারপরেই হাসপাতাল চত্বর ছেড়ে যান মুখ্যমন্ত্রী। এর পরেই তাঁর কথার ‘প্রতিবাদে’ আমরির প্রায় ২০০ কর্মী (বেশিরভাগই মহিলা) ঢাকুরিয়া ব্রিজ অবরোধ করেন। সেখানে কিছু পুরুষ কর্মীর সঙ্গে সংবাদমাধ্যমের হাতাহাতিও হয়। পরে ওই ঘটনায় ডি এন রায় ও তপন নস্কর নামে দুই হাসপাতাল কর্মীকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
আমরি-কর্মীদের অবরোধের জেরে গোটা এলাকায় যানবাহন স্তব্ধ হয়ে যায়। বেলা তখন প্রায় ১২ টা। ব্যস্ত সময়ে চারদিকে যানজট শুরু হয়ে যায়। আমরির কর্মী মহুয়া, ইন্দ্রাণী, রাখী, আখলিমা, স্বাগতা, সমর, নীলাঞ্জনারা চিৎকার করে বলতে থাকেন, “কর্তৃপক্ষের দোষ মুখ্যমন্ত্রী আমাদের ঘাড়ে চাপাতে পারেন না! ওই ঘটনায় আমরাও একইরকম শোকাহত। যখনই দুর্ঘটনার খবর পেয়েছি, আমরাও হাসপাতালে এসে আপ্রাণ রোগীদের বাঁচানোর চেষ্টা করেছি। আগুন তো আর আমরা লাগাইনি! কিন্তু আমাদের চাকরিই অনিশ্চিত! সে কথা বলতে গিয়ে আমাদের অপমানিত হতে হল!”
তাঁদের আরও বক্তব্য, “আমাদের অনেকেই পরিবারের একমাত্র রোজগেরে। চাকরি চলে গেলে পথে বসব। মুখ্যমন্ত্রী সে কথা না-শুনে আমাদের দোষী বলে গেলেন। এটা অন্যায়। আমরা মানব না।” বিক্ষোভ যখন ক্রমশ বাড়ছে, তখন রাস্তার একপাশে লাঠি হাতে চুপচাপ দাঁড়িয়ে পুলিশ। আচমকা পঞ্চাননতলা বস্তির দিক থেকে ধেয়ে আসে মারমুখী জনস্রোত। অশ্রাব্য গালিগালাজ করতে-করতে পুলিশের সামনেই বেধড়ক মারতে থাকে পুরুষ কর্মীদের। মহিলা কর্মীদের ধাক্কা দিয়ে, টেনে-হিঁচড়ে, চুলের মুঠি ধরে রাস্তা থেকে সরিয়ে দেয় জনতা। মহিলা কর্মীরা পুলিশের সাহায্য চাইলে তারা উল্টে বলে, “এখানে মহিলা পুলিশ নেই! ঝামেলা করবেন না। তাড়াতাড়ি চলে যান।”
মারমুখী জনতা তখন চিৎকার করছে, “এতগুলো মানুষ মেরে আবার চাকরি চাইতে গিয়েছে। এতদিন টাকা কামিয়ে লোভ কমেনি? মানুষের জীবন আগে না চাকরি আগে? এখানে এলেই মেরে ফেলে দেব! আমরির সব হাসপাতাল কলকাতা থেকে গুটিয়ে দেব।” প্রাণভয়ে এদিক-ওদিক দৌড়োতে থাকেন মহিলা কর্মীরা। ক্ষিপ্ত জনতার একাংশ তত ক্ষণে হাসপাতালে ঢুকে ডিসপেনসারি, ইমার্জেন্সি ভেঙে তছনছ করছে। আশপাশের কয়েকটি দোকানে চড়াও হয়ে ঝাঁপ বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছে পুলিশের সামনেই। অন্যদল তাড়া করেছে মহিলা কর্মীদের। কোনওক্রমে হাসপাতালের পিছনের দরজার তালা খুলে ভিতরে ঢুকে রক্ষা পান তাঁরা। |