পুলিশ ‘সংবেদনশীল’ হোক। পুলিশের প্রতি ‘মানবিক’ হোক আমজনতা। আর ‘সংযত’ হোক সংবাদমাধ্যম চান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মঙ্গলবার যাদবপুরের কিশোর ভারতী স্টেডিয়ামে কলকাতা পুলিশের ‘অলঙ্করণ সমারোহ-২০১১’ অনুষ্ঠানে তেমনই বলেছেন তিনি।
প্রথম আবেদনের কারণ বগুলা এবং মগরাহাট। যেখানে জনতাকে ‘ছত্রভঙ্গ’ করতে গিয়ে গুলি চালিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েছে পুলিশবাহিনী। দু’টি ঘটনায় মোট তিন মহিলার মৃত্যু হয়েছিল। আর দ্বিতীয় আবেদনের কারণ এ দিনই ব্রড স্ট্রিটের একটি নার্সিংহোমে সাংবাদিকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ। সাংবাদিকদের একাংশের উপর লাঠি চালানোর অভিযোগে কড়েয়া থানার এক পুলিশকর্মীকে দ্রুত সাসপেন্ড করা হয়। বিধানসভায় রাজ্যের বর্ষীয়ান মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় বলেন, “এমন ঘটনা অনভিপ্রেত। সরকারের তরফে আমরাও সতর্ক থাকব।”
এ দিন যাদবপুরের অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “লাঠি চালানো, গুলি চালানো একটু ছেড়ে দিতে হবে। লাঠি-গুলি না-চালিয়েও কৌশলে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়। লাঠি-গুলি না-চালিয়েও যে কলকাতা পুলিশ ভাল কাজ করতে পারে, তা আমাদের প্রমাণ করে দিতে হবে। চেষ্টা করুন, ঠিক পারবেন।” |
ঘটনাচক্রে, প্রায় তার কাছাকাছি সময়েই ঘটে ব্রড স্ট্রিটের ঘটনা। ওই ঘটনার কথা উল্লেখ করেই মুখ্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, “আপনারাও কাজ করুন। পুলিশকেও কাজ করতে দিন। আমরা যৌথ পরিবার। এক সঙ্গে থেকে কাজ করতে হবে। এ ধরনের ঘটনা ভালো নয়।” মুখ্যমন্ত্রীর আরও বক্তব্য, “হাসপাতালে সংবাদমাধ্যমের লোকেরা হুড়োহুড়ি করে ঢুকলে অন্যান্য রোগীদের অসুবিধা হয়। সেটাও আপনাদের খেয়াল রাখতে হবে। যে কারণে আমি নিজেও বিশেষ হাসপাতালের ভিতরে ঢুকি না।” ঘটনাচক্রে, এই বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতার সঙ্গে ‘একমত’ সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসুও। তাঁর কথায়, “সাংবাদিকদেরও সংযত থাকা প্রয়োজন। তাঁদেরও অনুশাসন মেনে চলতে হবে।”
মুখ্যমন্ত্রী এ দিন সাধারণ মানুষকেও পুলিশের প্রতি ‘মানবিক’ আচরণ করার আবেদন জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির নজরদারি ছাড়া পুলিশকে আরও কাজ করতে হয়। পর্যাপ্ত পুলিশ নেই। পুলিশবাহিনী উর্দি পরে বলেই আমরা তাঁদের দোষারোপ করতে পারি না। ওঁদের প্রতিও মানবিক হতে হবে।” মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, “শুধু পুলিশকে দোষারোপ করলে হবে না। সাধারণ মানুষকে সচেতন হতে হবে। বাড়ির সদর দরজা বন্ধ রাখুন। নিজের বাড়ির নিরাপত্তার বিষয়টিও ভাবুন।” অনুষ্ঠানে হাজির পুলিশকর্তাদের তিনি বলেন, “থানাভিত্তিক জন-সচেতনতা কমিটি গড়ুন। সাধারণ মানুষকেও সচেতন করতে হবে।”
অনুষ্ঠানে আমরি হাসপাতালের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় পঞ্চাননতলার ৬৬ জন ‘সাহসী’ যুবককে পুলিশ-পদক ও নগদ ৫ হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হয়। ওই যুবকদের গ্রিন পুলিশে নিয়োগ করার সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছে বলে মুখ্যমন্ত্রী জানান। অনুষ্ঠানে মোট ২৯ জন পুলিশকর্মীকেও পদক দেওয়া হয়। কৃতিত্ব অনুযায়ী ওই পুলিশকর্মীদের নিষ্ঠা, প্রশংসা ও সেবা পদক প্রদান করা হয়। পদকের সঙ্গে যে আর্থিক পুরস্কার দেওয়া হয়, অনুষ্ঠান মঞ্চে বসেই তার পরিমাণ বৃদ্ধি করার সিদ্ধান্ত নেন মুখ্যমন্ত্রী। অথর্মন্ত্রী অমিত মিত্রেরও খোঁজ করেন তিনি। অর্থমন্ত্রী অবশ্য সেখানে ছিলেন না। পরে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “রাজ্যের আর্থিক অবস্থা ভাল নয়। টাকা থাকলে পুলিশকর্মীদের জন্য সব রকম ব্যবস্থাই করতাম। এখন যতটা পারছি, করছি।” প্রসঙ্গত, গত ২৪ অগস্ট পুরভবনে যাওয়ার পথে কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় দুর্ঘটনায় জখম এক কিশোরীকে নিজের গাড়িতে তুলে নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছিলেন। চিকিৎসার ব্যবস্থা করার পাশাপাশি ওই কিশোরীর বাড়িতেও তিনি খবর দেন। তাঁর সেই ভূমিকার জন্য এ দিনের অনুষ্ঠানে কলকাতা পুলিশ মেয়রকে বিশেষ স্মারক প্রদান করে।
তার কিছুক্ষণ আগেই ঘটে ব্রড স্ট্রিটের ঘটনা। অর্ধেন্দু চক্রবর্তী (৫৮) নামে যাদবপুরের এক বাসিন্দা সোমবার ‘রুটিন চেক-আপ’-এর জন্য ভর্তি হন ব্রড স্ট্রিটের একটি নার্সিংহোমে। এ দিন সকালে নার্সিংহোমের ছাদ থেকে তাঁকে রাস্তায় পড়ে যেতে দেখা যায়। প্রাথমিক তদন্তে পুলিশের অনুমান, অর্ধেন্দুবাবু আত্মহত্যা করেন। তাঁর ছেলে পুলিশকে জানান, কিছু দিন যাবৎ বাবা মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন। তার জেরেই এই ঘটনা কি না, তা খতিয়ে দেখছে পুলিশ।
ওই খবর সংগ্রহ করতে গিয়েছিলেন বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিরা। পুলিশের বক্তব্য, মৃতের ছেলে বারণ করা সত্ত্বেও কিছু সাংবাদিক ‘জোর করে’ নার্সিংহোমের ভিতরে ঢুকতে চান। সাংবাদিকদের পাল্টা অভিযোগ, কর্তৃপক্ষের বক্তব্য জানতে ঢুকতে চাইলে পুলিশ বাধা দেয়। এর পরেই কড়েয়া থানার এক পুলিশকর্মী এক সাংবাদিককে ধাক্কা দিয়ে লাঠিপেটা করে রাস্তায় ফেলে দেন বলে অভিযোগ। এক সাব-ইন্সপেক্টর অন্য একজনের কাছ থেকে লাঠি কেড়ে ওই সাংবাদিকের দিকে তেড়ে যান বলেও অভিযোগ। আহত হন আরও এক সাংবাদিক।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বিরাট বাহিনী নিয়ে ঘটনাস্থলে যান সাউথ-ইর্স্টান ডিভিশনের ডিসি বাসব দাশগুপ্ত। যান দমকল মন্ত্রী জাভেদ খানও। পরে কুমার ছেত্রী নামে এক পুলিশকর্মী (যিনি লাঠি মেরেছিলেন)-কে সাসপেন্ড করা হয়। অভিযুক্ত সাব-ইন্সপেক্টর এবং আরও এক পুলিশকর্মীর আচরণ খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানা গিয়েছে লালবাজার সূত্রে।
অধিবেশন চলাকালীন এমন ঘটনা ঘটায় স্বভাবতই বিধানসভায় সরকারের বক্তব্য জানতে চায় বিরোধীরা। মন্ত্রী সুব্রতবাবু বলেন, “আমরি হাসপাতালের অগ্নিকাণ্ডের পরে কিছু মানুষ অত্যুৎসাহী হয়ে পড়ায় সমস্যা হচ্ছে। ওই ঘটনার জন্য দুঃখপ্রকাশ করছি। পুলিশ বিনা প্ররোচনায় লাঠি চালিয়েছে। এমন ঘটনা অনভিপ্রেত।” প্রদেশ কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নান বলেন, “পুলিশের মানসিকতা পরিবর্তন করা জরুরি। আশা করব, এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না।” এসইউসি এবং সিপিআই(এমএল) নিউ ডেমোক্র্যাসিও ওই ঘটনার নিন্দা করেছে। দিল্লিতে পলিটবুরো বৈঠকের ফাঁকে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক তথা রাজ্য বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু “সাংবাদিকদের চিহ্নিত করে নিগ্রহ করা হয়ে থাকলে সেটা গর্হিত অপরাধ। এর জন্য একটি বিধান করা উচিত। নইলে সাংবাদিকদের সংবাদ সংগ্রহ করতে অসুবিধা হবে।” আমরি হাসপাতালের কর্মীরা যেভাবে সাংবাদিকদের একাংশের উপর ‘চড়াও’ হন, তা সমর্থন করেননি বিমানবাবু। তাঁর কথায়, “আমরি-র মতো এত বড় ঘটনা অতীতে সারা ভারতে ঘটেনি। তা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার জন্য যদি সাংবাদিকদের আক্রমণ করা হয়, তা হলে তা ঠিক নয়। সংবাদমাধ্যমেরও রক্ষাকবচ থাকা উচিত।” |