কেন্দ্রীয় নির্দেশিকা মেনে বাড়ি তৈরির নতুন আইন করাটাই সব নয়। বাড়ি তৈরির পরে তাতে বেআইনি ভাবে যে পরিবর্তন ও সম্প্রসারণ হয়ে থাকে, তা রুখতেও চাই আইনি ‘রক্ষাকবচ’। এবং কড়া নজরদারির ব্যবস্থা। জাতীয় গৃহনির্মাণ নির্দেশিকা বা ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড-এর (এনবিসি) ভিত্তিতে রাজ্যে প্রস্তাবিত নির্মাণ আইনের রূপরেখা তৈরির সময় এই বিষয়টিও মাথায় রাখা হবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য সরকার।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে নতুন আইন নিয়ে মাথা ঘামাতে শুরু করে গোড়াতেই বেআইনি নির্মাণ ঠেকানোর বিষয়টি নিয়ে দুশ্চিন্তায় সংশ্লিষ্ট মহল। রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের কথায়, “বাড়ি তৈরির পরে বেআইনি পরিবর্তন ও সম্প্রসারণই হল নষ্টের গোড়া। তাই শুধু কেন্দ্রীয় সুপারিশ মেনে বাড়ি তৈরি করলেই হবে না। দেখতে হবে এর পরে যেন কেউ সেই বাড়িতে গোলমাল করতে না-পারে।”
বস্তুত, নন্দরাম মার্কেট থেকে স্টিফেন কোর্ট বা ঢাকুরিয়ায় আমরি হাসপাতালের টাটকা বিপর্যয় তিনটির ক্ষেত্রেই বাড়ির মূল নকশা থেকে বিচ্যুতির সঙ্গে অঘটন বা অগ্নিকাণ্ডের যোগ রয়েছে। অর্থাৎ, ভূত লুকিয়ে রয়েছে বেআইনি পরিবর্তন ও সম্প্রসারণকে আইনি করে নেওয়ার মধ্যে।
|
ফিরহাদ হাকিম
পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী |
নন্দরামের ক্ষেত্রে অগ্নিকাণ্ডের পরেই উপরের আটটি তল যে বেআইনি, তা ধরা পড়েছিল। স্টিফেন কোর্টেও উপরের দু’টি তল বেআইনি ছিল। পরে পুরসভাকে দিয়ে ‘অনুমোদন’ করানো হয়। আমরি হাসপাতালের ট্র্যাজেডিতেও দেখা যাচ্ছে, যে বেসমেন্টে দাহ্য পদার্থে আগুন লাগা থেকেই বিপত্তির সূত্রপাত, সেই বেসমেন্টের মূল নকশায় কিন্তু স্রেফ গাড়ি রাখার ছাড়পত্র ছিল। বেসমেন্টে রদবদল ঘটিয়ে সেন্ট্রাল স্টোর বা রেডিওথেরাপি ইউনিট চালানোটা এক কথায় ‘বেআইনি’ বলে তদন্ত করার কথা বলছেন কলকাতার পুর-কর্তৃপক্ষ। যদিও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবি, পুর আইনের একটি ধারা মেনেই ‘রদবদল’ ঘটানো হয়েছে।
এই জায়গাটিতেই সতর্ক পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী। তাঁর কথায়, “নতুন আইনে পেনাল্টি বা জরিমানা নিয়ে বেআইনি নির্মাণ রেগুলারাইজ বা নিয়মিত করার অভ্যেস বন্ধ করতে হবে পুরসভাকে। মূল পরিকল্পনা থেকে যথেচ্ছ রদবদলের বিষয়টি নিয়েও সতর্ক থাকা উচিত। দেখতে হবে, সেই রদবদলের পরে কোনও বিপদের আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে কি না।” কলকাতা পুরসভার প্রাক্তন ডিজি (বিল্ডিং) অশোক রায়চৌধুরীর নেতৃত্বে বিদ্যুৎ, নগরোন্নয়ন, পূর্ত বিভাগ, পুলিশ, দমকল, বিপর্যয় মোকাবিলা দফতর-সহ বিভিন্ন বিভাগের কর্তাদের নিয়ে যে কমিটি গড়া হচ্ছে, নতুন নির্মাণ আইন তৈরির সময়ে তাঁদের এই বিষয়গুলি মাথায় রাখতে বলা হবে বলে জানাচ্ছেন মন্ত্রী।
কিন্তু বাড়ি তৈরির পরবর্তী বেআইনি নির্মাণ বা পরিবর্তনকে ‘আইনসিদ্ধ’ করার পদ্ধতিটি আদৌ আইনি?
পুর-আইন বিষয়ে অভিজ্ঞ কলকাতা পুরসভার এক প্রাক্তন কর্তার কথায়, “আসলে পুর-আইনে বেআইনি নির্মাণ নিয়মিতকরণের সুযোগ নেই। কিন্তু বাস্তবে পুরসভা সেটাই করে থাকে। কোনও বহুতলে বেআইনি ভাবে তৈরি বাড়তি কয়েকটি তল নির্মাণের পরে পুরকর্তারা প্রোমোটারের সঙ্গে আলোচনার পরে তাঁকে কিছু ‘পেনাল্টি’ বা জরিমানা দিতে বলেন। জরিমানার টাকা পেয়ে পুর-কর্তৃপক্ষ লিখে দেন, ওই তলাগুলি থেকে বিপদের কোনও সম্ভাবনা নেই। ব্যস, এতেই বেআইনি তলাগুলি বৈধ হয়ে যায়।”
পুরসভা সূত্রের খবর, এই পেনাল্টি-পদ্ধতি এতটাই বহুলপ্রচলিত যে পুরকর্তারাও অনেক সময়ে এটাকে আইনসম্মত বলে ভুল করেন। আসলে কিন্তু এই পেনাল্টি আদায়ের পদ্ধতিটিই বেআইনি। কলকাতা পুরসভার বিল্ডিং বিভাগের এক আধিকারিকের কথায়, “নকশা অনুমোদন করাতে আইনসম্মত ভাবে যে টাকা দিতে হয়, পেনাল্টি বাবদ তার থেকে কিছুটা বেশি টাকা নেয় পুরসভা। টাকাটা পুরসভার তহবিলেই যায়। সহজে ঝামেলা চুকে যায় বলে সাধারণত কোনও প্রোমোটারই এই পদ্ধতিতে আপত্তি করে না।” এ প্রসঙ্গেই এক পুরকর্তা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, স্টিফেন কোর্টের উপরের দু’টি বেআইনি তলা এ ভাবেই আইনি হয়ে উঠেছিল।
এ রাজ্যে বেশ কয়েকটি নির্মাণ প্রকল্পের নকশা তৈরির সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্যবিদ্যার শিক্ষক মধুমিতা রায়। স্থাপত্যে অগ্নি-বিধি আঁটোসাঁটো করতে দমকলকেও তিনি পরামর্শ দিয়ে থাকেন। মধুমিতাদেবীর কথায়, “বেআইনি নির্মাণের পিছনে অনেক ক্ষেত্রেই একটা রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা থাকে। পুরসভার মেয়র বা মেয়র পারিষদেরা সব বুঝেও বেআইনি নির্মাণ মেনে নেওয়ার পথে হাঁটেন। নতুন আইনে এই পথ বন্ধ হলে সবারই ভাল।”
বিরোধী দল সিপিএমের নেতা তথা প্রাক্তন মেয়র পারিষদ সুধাংশু শীলও নির্মাণকাজের পিছনে রাজনৈতিক প্রভাব দূর করার চেষ্টাকে স্বাগত জানাচ্ছেন। সুধাংশুবাবু বলেন, “মেয়র বা মেয়র পারিষদদের প্রভাব খাটানোর সুযোগ থাকা উচিত নয়। এই ধরনের আইন হলে, বেআইনি নির্মাণকে বৈধতা দিতে পুরসভার অন্দরে দুর্নীতির সুযোগও কমবে।”
নতুন আইন মেনে বাড়ি তৈরি হলেও তার পরে নজরদারির অভাবেই বেআইনি নির্মাণকাজের সম্ভাবনা থেকে যাচ্ছে বলে অনেকে মনে করছেন। নির্মাণকারী সংস্থাদের সংগঠন ক্রেডাই-ও এই নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। ক্রেডাই-এর প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট সন্তোষ রুংতা বলেন, “বাড়ি তৈরি হয়ে যাওয়ার পরে ভিতরে বেআইনি ভাবে কিছু তৈরি করা হল কি না, তার জন্য নজরদারি কোথায়?” ক্রেডাই-এর আর এক সদস্য প্রদীপ সুরেকাও বলেন, “অনেক সময় দেখা যায় ডেভেলপার নিয়ম মেনে বাড়ি তৈরি করে তা ক্রেতাদের হাতে তুলে দিয়েছে। কিন্তু পরে সেখানে নিজের ইচ্ছে মতো বাড়তি নির্মাণ কাজ করেছেন ক্রেতা। মানা হচ্ছে না আগুনের বিপদ নিয়ে বিধিনিষেধও।”
শহরের বহুতলগুলিতে অগ্নি-বিধি পরীক্ষার ক্ষেত্রে টালবাহানার পিছনে দমকলও বারবারই লোকাভাবের কারণ দেখায়। স্থাপত্যবিদ্যার শিক্ষক মধুমিতাদেবীর কথায়, “নতুন আইন তৈরিই সব নয়। আধুনিক স্থাপত্যের কৃৎকৌশল বুঝে ফায়ার-লাইসেন্স দিতে হলেও দমকলকর্তাদের বিশেষজ্ঞের সাহায্য নেওয়া উচিত। আইন তৈরির সঙ্গে-সঙ্গে তা কার্যকর করতে দমকলের পরিদর্শনও নিয়মিত হওয়া দরকার।” |