লক্ষ লক্ষ হাতে
অন্ধকারকে দু’টুকরো করে
অগ্নিকোণের মানুষ
সূর্যকে ছিঁড়ে আনে।
কোটি কণ্ঠের হুঙ্কারে লাগে
বজ্রের কানে তালা।
পোড়া মাঠে মাঠে বসন্ত ওঠে জেগে॥
অগ্নিকোণ/ সুভাষ মুখোপাধ্যায়
বাঁ হাতটা ছুঁয়ে আছে নিথর স্বজনের মুখমণ্ডল! নির্মম শোকের প্রতিলিপি হয়ে হাসপাতালের মেঝেয় বসে আছেন সেই যুবক, ডান হাতে মোবাইল, পৌঁছে যাচ্ছে অমোঘ বার্তা! ক্রমে ক্রমে রটে গেছে সেই বার্তা আরোগ্য নিকেতন পরিণত হয়েছে মৃত্যুপুরীতে! এই শহর থেকে ভিন শহর, এই রাজ্য থেকে ভিন রাজ্য, ভিন দেশ হতে হতে বিশ্বময়!
একের পর এক লাশ ভিড় জমিয়েছে হাসপাতালের আনাচকানাচে। সুস্থ করে তোলার আপ্রাণ প্রয়াসের আপাত-অঙ্গীকার করে যাঁদের নিজের জঠরে পুরে নিয়েছিল সেই চিকিৎসাকেন্দ্র! কত না ভিড়! অ্যাম্বুল্যান্স-পুলিশ-মন্ত্রী-সান্ত্রি-মিডিয়া-লাখো মানুষের জনতা-জননেতা!
আর সেই ভিড়ে মিশে আছেন তাঁরাও। নিজেদের জীবনের পরোয়া না করে সে দিন গভীর রাতের সুখনিদ্রা ছেড়ে যাঁরা আমরি হাসপাতালের পাঁচিল টপকে ভিতরে ঢুকে পড়েছিলেন। ইট ছুড়ে ভাঙার চেষ্টা করেছিলেন হাসপাতালের জানলার শক্ত কাচ। নিরাপত্তারক্ষীদের বাধা অগ্রাহ্য করে হাসপাতালের মূল ফটক খুলে দিয়ে ভিতরে ঢুকতে সাহায্য করেছিলেন বাকিদেরও।
যেন চরাচর ভেসে যাচ্ছিল অসহায় মানুষগুলোর ‘বাঁচাও বাঁচাও’ চিৎকারে! ওই চরম বিপদের মুহূর্তে যাঁদের হাত ‘ঈশ্বরের হাত’ হয়ে এগিয়ে আসার কথা, তাঁরা প্রায় কেউ নেই। পালিয়েছেন। আর তাঁদের বদলে এগিয়ে এসেছিলেন যাঁরা, তাঁরা কার্যত ব্রাত্য এ সমাজে। ‘বস্তির ছেলেরা’ কেউ টর্চ জ্বেলে, কেউ বা মোবাইলের আলোয় হাতড়ে হাতড়ে নিষ্প্রদীপ হাসপাতালের কোণে কোণে খুঁজে বেড়িয়েছেন রোগীদের। |
পঞ্চাননতলা বস্তি। আলোকিত ঢাকুরিয়ার আমরি হাসপাতালের পিছনে সামাজিক অন্ধকারে ঘেরা সে বস্তিতে ‘ভদ্রলোকেদের’ পা পড়ার কথা নয়। পড়েও না। এ বস্তির মানুষগুলো ওই অনেকটা ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’র বাঘারুর মতোই! আছে, অথচ নেই! এ সব এলাকাও যেন এ মহানগরীর ‘জঙ্গলমহল’! আছে বটে, তবে কেন আছে, কে জানে!
কী আশ্চর্য সমাপতন! এই যে গত ১০ ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধিকার দিবস পালিত হল বিশ্ব জুড়ে, মানবাধিকার রক্ষায় কত না নতুন প্রয়াস আর অঙ্গীকার রচিত হল রুটিনমাফিক, সেখানে কোথায় হবে পঞ্চাননতলা বস্তির মানুষগুলোর ঠাঁই? অথচ, তার আগেই তো না জেনে, না বুঝে, না ঘোষণা করে, মানবাধিকার রক্ষার, মানবতা রক্ষার লড়াইয়ে শামিল হয়ে গেলেন পঞ্চাননতলা বস্তির রাজু ভাণ্ডারী, রণজিৎ দাশগুপ্ত, বাসু দামকয়াল, রমাপদ পুরকাইত আর শঙ্কর মাইতিরা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার অবশ্য এই বস্তির ৬৬ জনকে বীরের সম্মান জানাবে। দম বন্ধ হয়ে আসা কালো বিষধোঁয়ার মধ্যে একটানা আট ঘণ্টা উদ্ধারকাজ চালিয়ে শঙ্কর মাইতি নিজেই আজ গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালের আইসিসিইউ-তে। বি কম অনার্সের ছাত্র শঙ্করের বাবা শশধর নিজেও তো এ সমাজের প্রান্তিক মানুষ! বাদাম বেচা পয়সায় কষ্টের সংসার চালানো শশধরের ছেলের এত সাহস যে কী করে আসে! যে হাসপাতালে তাঁদের মতো মানুষের কোনও রকম প্রবেশাধিকার থাকার কথাই নয়, সেখানেই অসহায় মৃত্যুর মুখ থেকে, মৃত্যু-গুহা থেকে মানুষগুলোকে উদ্ধারের জান কবুল করা প্রতিজ্ঞার মানসিক জোর তিনি পান কোথা থেকে!
এ যেন নাতসিদের তৈরি কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের কথা মনে করিয়ে দেয়! অভুক্ত, অত্যাচারিত মানুষগুলোকে সেখানে মেরে ফেলা হচ্ছে বিষ-গ্যাস দিয়ে! আর এখানে? এই হাসপাতালে? বিষ-গ্যাসের মারণ ছোবলে ঢলে পড়ছেন একের পর এক অসহায় মানুষ। বহু ক্ষেত্রেই সাধ্যের বাইরে গিয়ে, ঋণের বোঝায় জর্জরিত হয়েও স্বজনেরা যাঁদের এখানে এনেছিলেন আরোগ্যের আশায়!
আর তাঁদেরই উদ্ধারে সাজসরঞ্জামহীন, প্রশিক্ষণহীন, দিন-আনা-দিন-খাওয়া চেহারাগুলো ঝাঁপিয়ে পড়ল অনিশ্চয়তার ঘোর আঁধারে! এই যে এখন এত শোনা যায় মানবতার কথা, মানবাধিকার আন্দোলনের কথা, সেখানে মাঝে মাঝে মনে হয়, মানবাধিকারের পাঠশালার এই প্রাথমিক পাঠটাই কেমন যেন একটু নড়বড়ে! রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার সংক্রান্ত দাবি-সনদের কথা যদি না-ও ভাবি, যদি স্রেফ বিবেকের কথা ভাবি, যদি সামাজিক বোধবুদ্ধি একটু কাজে লাগাই, তা হলে কেন যেন মনে হয়, এই মানবাধিকার আন্দোলনের দিগন্ত আরও অনেকটা বড় হতে পারত। স্রেফ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, লক-আপে অস্বাভাবিক মৃত্যু, কিষেণজির মৃত্যুর নিরপেক্ষ তদন্তের দাবির বাইরে গিয়ে এই আন্দোলনটা যদি আরও একটু মানবিক হত!
যদি জেলা শহরে, গ্রামে গ্রামে মানবাধিকার আন্দোলনের সঙ্গে স্বাস্থ্য আন্দোলন, শিক্ষার আন্দোলনকেও মিলিয়ে দেওয়া যেত, তা হলে পঞ্চাননতলা বস্তির শঙ্কর মাইতিরা আরও অনেক বেশি করে এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হতে পারতেন! মানবাধিকার আন্দোলন খায় না মাথায় দেয়, তা ভেবে দূর থেকে বিস্মিত চোখে তাকিয়ে থাকতেন না। মানবাধিকার আন্দোলনের সঙ্গেই এই স্বাস্থ্য আন্দোলনকেই তো মিশিয়ে দিয়েছেন মানবাধিকার কর্মী বিনায়ক সেন। মানবাধিকার আন্দোলনের দিগন্তের আরও বিস্তারের কথাও তো বলেছিলেন আর এক মানবাধিকার কর্মী কে বালাগোপাল!
এক বারও বলছি না, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, লক-আপে মৃত্যু বা কিষেণজি-আজাদের মৃত্যুর তদন্ত দাবি করবে না মানবাধিকার সংগঠনগুলি অথবা এই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলবে না। সে সব তো করতেই হবে, তা না হলে তো রাষ্ট্র একতরফা তার দাঁত-নখ প্রদর্শন করেই যাবে! কিন্তু, তারও পাশাপাশি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ তৈরির কাজটাও করে যাওয়া প্রয়োজন।
গোটা হাসপাতালকে কার্যত গ্যাস চেম্বারে পরিণত করে যারা এতগুলি অসহায় মানুষের হত্যার কারণ হয়, তাদের বিরুদ্ধেও সরব হতে হবে মানবাধিকার কর্মীদের। যদি লক-আপে বন্দির অস্বাভাবিক মৃত্যুতে তদন্ত দল গঠন করতে পারে মানবাধিকার সংগঠনগুলি, নিরস্ত্র জনতার উপরে পুলিশের গুলিচালনার ঘটনায় বেসরকারি তদন্ত কমিশন বসাতে পারে, তা হলে শুধু সরকারি তদন্তের ভরসায় না থেকে তারা তো সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলির পরিকাঠামো নিয়ে, তাদের বেআইনি কাজকর্ম নিয়েও তদন্ত দল গঠন করতে পারে। বহু সমমনস্ক চিকিৎসক, চিকিৎসা কর্মীর সাহায্য তারা পাবেই।
মার্ক টোয়েন থেকে নোয়াম চমস্কি বারে বারে ‘স্ট্রাকচারাল ভায়োলেন্স’-এর কথা বলেছেন। আমরি-র ঘটনাও এক অর্থে সেই ‘স্ট্রাকচারাল ভায়োলেন্স’। তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে গর্জে উঠলে কিন্তু শঙ্কর মাইতিদের কাজের বোঝাটা একটু হাল্কা হয়!
মাথা গোঁজার ঠাঁই তো বস্তির সেই ‘দশ ফুট বাই দশ ফুট’-এ! সেখানে থেকেও কলজের এত জোর বাসু আর রাজুদের! কেউ অটো চালান, কেউ রাজমিস্ত্রির জোগাড়ে, কেউ হকার, কেউ বা নানা ভাবে সামান্য কিছু কাজ করেন। কোনও অঘটন ঘটলে আমরি-র মতো হাসপাতাল তো দূরের কথা, সরকারি হাসপাতালেও চিকিৎসা চালানো দুষ্কর যাঁদের, মানবতার প্রথম পাঠটা না হয় তাঁদের কাছ থেকেই একটু অন্তত শেখার চেষ্টা করা যাক! |