|
|
|
|
প্রবন্ধ ১...
যা দেখি, যা শুনি, একা একা কথা বলি |
|
কী অপূর্ব সুন্দর
কাটানো একটি সন্ধ্যা |
|
নাটক দেখতে দেখতে মনে হয়, সব চরিত্রের অভিনেতারাই একেবারে মানানসই। কেউ একটুও ভুলভাল
করল না, যথাযথ আবেগ ফুটিয়ে তুলল। ছোটদের অভিনয় দেখার এক স্মরণীয় অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় |
অনুষ্ঠানসূচিতে দেখলাম, দ্বিতীয়ার্ধে রয়েছে একটি বাচ্চাদের নাটক। আমাদের মতন যাদের মাঝে মাঝে মঞ্চে উঠতে হয় এবং বক্তৃতার নামে কিছু এলোমেলো কথা বললেই চলে, তারা এই ধরনের অনুষ্ঠানের প্রথম অংশ শেষ হলেই নানান ছুতো দেখিয়ে সরে পড়ে। আমিও। তবু কেন আমি সে দিনের ‘সায়ক’-এর অনুষ্ঠানে রয়ে গেলাম শেষ পর্যন্ত?
বয়েস হয়েছে তো, এখন ছোটদের সংস্পর্শ বেশি ভাল লাগে। হয়তো মানুষ ওই সব শিশুর মধ্যে নিজের শৈশব খোঁজে। একটা ব্যাপার দেখা যায়, মানুষ তার ছেলেমেয়েদের প্রতি যতটা স্নেহ দিতে পারে, তার চেয়ে অনেক বেশি স্নেহপ্রবণ হয় নাতিনাতনিদের প্রতি। ছেলেমেয়েদের তবু মাঝে মাঝে শাসন করতে হয়, নাতিনাতনিদের বেলায় সে প্রশ্ন নেই, শুধু আদর আর প্রশ্রয়।
আমাদের বাড়িতে কোনও শিশু নেই। কয়েক দিন আগে আমাদের ছেলে সপরিবার এসে ঝটিকা সফরের পর ফিরে চলে গেছে প্রবাসে, এখন আমাদের ফ্ল্যাট আগের চেয়ে তিন গুণ ফাঁকা। তাই বাৎসল্যরসের টানেই আমি বসে রইলাম দর্শক আসনে। এখন স্কুল ছুটির পর ছাত্রছাত্রীদের উজ্জ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে ভাল লাগে, এমনকি টিভি-র বিজ্ঞাপনে কোনও শিশুশিল্পী থাকলেই আগ্রহের সঙ্গে দেখি, খবরের কাগজে যখন জানা যায়, কোনও বাচ্চা ছেলে বা মেয়েকে ধরে নিয়ে গিয়ে মুক্তিপণ চাইছে বদমাসরা, তখন ইচ্ছে করে ছুটে গিয়ে ওই বদমাসগুলোকে... ইচ্ছে তো হয় অনেক কিছুই, কিন্তু আমার আর সাধ্য কতখানি!
নাটক শুরু হওয়ার আগে একটা তথ্য জেনে আশ্চর্য হলাম, ‘সায়ক’-এর ছোটদের বিভাগে ছয় থেকে ষোলো বছরের প্রায় চল্লিশটি ছেলেমেয়ে নাটকের ট্রেনিং নেয়। রুদ্রপ্রসাদদের ‘নান্দীকার-এও এ রকম বিভাগ আছে অনেক দিন, অন্য বড় বড় নাটকের দলেও এ সব ব্যবস্থা আছে কি না জানি না। তার মানে কি এই যে, এখন অভিভাবকরা ছেলেমেয়েদের নাটক-অভিনয় শিক্ষা করার জন্য পাঠাচ্ছেন? আমাদের বাল্যকালে তো এটা অকল্পনীয় ছিল। বাবা-মায়েরা সন্তানদের শুধু বলতেন, পড়, পড়, পড়, ফার্স্ট-সেকেন্ড হ! উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েদের বড়জোর কিছু দিনের জন্য সাঁতারের ক্লাসে নিয়ে যাওয়া হত। কিন্তু নাটক শেখা? এর সঙ্গে কি জীবিকার যোগ আছে? নাট্যজগতে দু-চার জনই বিখ্যাত হয়ে স্বাবলম্বী হতে পারেন, সে-ও অনিশ্চয়তার ব্যাপার। আসলে এই সব ছেলেমেয়ে প্রায় সবাই জীবিকার জন্য অন্য পড়াশুনো চালিয়ে যাবে নিশ্চয়ই, তবে এই স্বল্পকালীন নাট্যশিক্ষাও অবশ্যই কাজে লেগে যাবে। বাকি জীবনে তাদের নাটকের সঙ্গে সম্পর্ক থাকুক বা না থাকুক, তারা শুদ্ধ উচ্চারণে কথা বলতে শিখবে, নাটকের পাত্রপাত্রীদের সমতুল্য অনেক চরিত্রেরও দেখা মিলবে। |
|
এই প্রসঙ্গে একটা ঘটনা বলি। কোল ইন্ডিয়ার একটা অনুষ্ঠানে এক বার গিয়েছিলাম মধ্যপ্রদেশে। খাতিরযত্নের অভাব নেই, ঠিকঠাক চলছে সবই। দ্বিতীয় দিনে শুনলাম, সেই সংস্থার সর্বোচ্চ পদাধিকারী এক জন বাঙালি, তিনি আমাদের সঙ্গে সৌজন্যমূলক সাক্ষাৎকারে আসবেন, অতি ব্যস্ত তিনি, সময় মাত্র পনেরো মিনিট, আমরা যারা আমন্ত্রিত, তারা যেন নির্দিষ্ট সময়ে এক জায়গায় বসে থাকি। যথা সময়ে তিনি এলেন, অত বড় অফিসাররা বাঙালি না পাঞ্জাবি, তাতে কিছু আসে যায় না, তাঁদের মুখে লেগে থাকে নকল গাম্ভীর্য, কথা বলেন একটু ভুরু তুলে, এবং আর সবাই যেন তাঁর অধস্তন কর্মচারী। এই ধরনের বড় অফিসারদের সামনে পাঁচ মিনিটের বেশি বসে থাকতে আমার চুলকুনি হয়, সিগারেট টানার অছিলায় উঠে যাচ্ছিলাম, আজ এক জন ফিসফিস করে আমার কানে কানে বললে, জানেন তো, ইনি এক সময় বহুরূপীতে অভিনয় করতেন। তা শুনে আমার কৌতূহল হল, আমি ফিরে গিয়ে সব প্রোটোকল ভেঙে তাঁর সামনে গিয়ে বললাম, হ্যাঁ মশাই, আপনি নাকি এক সময় বাংলা নাটকে অভিনয় করতেন? সে সব কোনও নাটকের কথা মনে আছে?
তিনি তক্ষুনি কোনও উত্তর না দিয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন এক-দেড় মিনিট। তাঁর মুখ থেকে মিলিয়ে যেতে লাগল নকল-কঠোর ভাব, তিনি টাই খুলে ফেললেন, তার পর চমৎকার উদাত্ত গলায় উচ্চারণ করতে লাগলেন বিসর্জন নাটকে জয়সিংহের সংলাপ। তখন আর তাঁকে শুধু অফিসার নয়, এক জন সম্পূর্ণ মানুষ বলে মনে হতে লাগল।
‘সায়ক’-এর এই কিশোর-নাট্যটির নাম মানিকচাঁদ। সুপরিচিত নাট্যকার চন্দন সেন এটা লিখে দিয়েছেন। ঠিক রূপকথা নয়, আবার বাস্তব কাহিনিও নয়, দুইয়ের সংমিশ্রণ বলা যায়। অভিনেতাদের মধ্যে এক জনও অভিজ্ঞ, বয়স্ক নেই, সবাই শৈশব থেকে কৈশোরে পৌঁছনো। মেঘনাদ ভট্টাচার্য কী দারুণ যত্নে এদের শিখিয়েছেন, কেউ একটুও ভুলভাল করল না, বরং যথাযথ আবেগ ফুটিয়ে তুলল। আমি আশা করছিলাম, কেউ এক জন পার্ট ভুলে গিয়ে আমাদের আরও আনন্দ দেবে। না, তা হল না, এরা সবাই যেন বাচ্চা প্রফেশনাল! এদের নাচ ও গান শিখিয়েছেন কবীর সেন বরাট আর শুভেন্দু মাইতি, এ সব নাটক নাচগান ছাড়া জমে না।
প্রথম বার একটা নাটক দেখতে দেখতে মনে হয়, সব চরিত্রের অভিনেতারাই একেবারে মানানসই। ঠিক যেন খুঁজে খুঁজে জোগাড় করে আনা হয়েছে। বড়দের নাটকে এ রকম হয় না, তখন তো বেশ কয়েক জন চেনাই থাকে, আর তাই আমরা মনে করি, এই এই ভূমিকায় এই এই অভিনেতা মঞ্চে এসেছেন। কয়েক বছর আগে রমাপ্রসাদ বণিকের ‘একলা পাগল’নামে অসাধারণ নাটকটি একটি স্কুলেরছেলেমেয়েদের দিয়ে অভিনয় উপস্থাপনা দেখেছিলাম। সেখানে একটি পাঞ্জাবি চরিত্রের মেয়েটিকে মনে হয়েছিল অবশ্যই পাঞ্জাবি, কিছু কিছু বাংলা কথা শিখেছে। পরে দেখি, সে এক লাজুক বাঙালি মেয়ে। এ সবইপরিচালকের কৃতিত্ব। এই নাটকেও শিহরন জাগানো অনেক মুহূর্ত আছে। মূল চরিত্র মানিকচাঁদের ভূমিকায় যে ছেলেটি অভিনয় করছে, তার বর্ণনায় আছে, তার মাথাভর্তি সোনালি চুল, আর গায়ের রং খুব ফর্সা। সোনালি চুলটা কোনও সমস্যা নয়, কিন্তু বেশি পাউডার ঘষেও সত্যিকারের ফর্সা হওয়া যায় না। এই মানিকচাঁদ সত্যি সত্যি খুব ফর্সা, কী সুন্দর, সরল তেজের সঙ্গে সে অভিনয় করে গেল, দেখতে দেখতে আর সময়জ্ঞান রইল না আমার। কী অপূর্ব সুন্দর কাটল যে এই সন্ধেটা!
নাটকটা শেষ হতেই একটি যুবতী আমার সামনে এসে জিজ্ঞেস করল, সুনীলকাকা, আমায় চিনতে পারছ না?
আমি কিছু উত্তর দেওয়ার আগেই সে বলল, আমি মতি নন্দীর ছোট মেয়ে, আমার ছেলে আজ অভিনয় করেছে।
মতি নন্দীর তিন মেয়েই খুব ফর্সা, ওদের মায়ের মতন, ওদের ছেলেমেয়েরাও সে রকমই হবে।
কোন ভূমিকায় অভিনয় করেছে তোমার ছেলে?
ওই যে, নায়ক, মানিকচাঁদ। মতি নন্দী আমার বিশিষ্ট বন্ধু ছিল, তার নাতি তো আমারও নাতির মতন। তার প্রতি আমার কিছুটা পক্ষপাতিত্ব তো থাকতেই পারে। কিন্তু তার পরিচয় না জেনেই তো আমি আগেই মানিকচাঁদের ভূমিকায় দীপচাঁদকে ফার্স্ট করে দিয়েছি!
|
অমুক ওয়েডস ওমুক |
এখন যাকে বলে বিয়ের সিজন। পাড়ায় পাড়ায় সুসজ্জিত বিয়েবাড়িগুলোর বাইরে ফুলের অক্ষরে লেখা থাকে ‘সঞ্জয় ওয়েডস বনলতা’, ‘বিমান ওয়েডস নয়না’ ইত্যাদি। দেখলেই বিরক্তিতে আমার নাক কুঁচকে যায়। না, ইংরিজি ভাষার জন্য নয়, যার যা ইচ্ছে তা তো লিখতেই পারে, আর সামাজিক-সাংস্কৃতিক নির্বুদ্ধিতার এই উদাহরণ এ যুগেও দেখলে আমারও নাক কুঁচকোবার অধিকার থাকবেই। আজও শুধু ছেলেরাই বিয়ে করে? আর মেয়েদের বিয়ে হয়! তাদের সমান অধিকার নেই। এরই মধ্যে এক বিয়েবাড়ির বাইরে লেখা: ‘সুরেলা-রাহুলের শুভ বিবাহ’, তা দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। |
|
|
|
|
|