পাঁচতলা বাড়িটিতে একটাই মাত্র সিঁড়ি। তা-ও আবার চওড়ায় মাত্র তিন ফুট। আর রয়েছে ছোট একটি লিফ্ট।
বাড়ি ভর্তি মানুষ। তিনতলায় কুড়ি বাই বারো ফুটের একটি ঘর। বর-কনেকে বসানো হয়েছে সেখানে। পাশে খোলা জায়গায় জ্বলছে হোমের আগুন। তারই এক পাশে কফি মেশিন। চারতলায় খাওয়ার জায়গায় বসতে পারেন ৭৫ জনের মতো। পাঁচতলায় চলছে গ্যাস জ্বালিয়ে রান্না। এ দিকে-ও দিকে ঝুলছে খোলা তার। বাড়ির দোতলায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক ও একতলায় মোবাইল পরিষেবা সংস্থার দোকানের এসি মেশিনে ওই তার ঢুকে গিয়েছে।
আগুন লাগার সব উপাদনই মজুত। কিন্তু কোথাও মজুত নেই আগুন নেভানোর উপকরণ। এমনকী, নেই পর্যাপ্ত জলের ব্যবস্থাও। এ ভাবেই প্রতিদিন কোনও না কোনও অনুষ্ঠান চলছে শ্যামবাজারের ভূপেন বসু অ্যাভিনিউ সংলগ্ন বাড়িটিতে। |
একই অবস্থা আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রোডে ছায়া সিনেমা লাগোয়া বাড়িটিরও। বাইরে থেকে পরিত্যক্ত বাড়ি মনে হতেই পারে। ঢোকার রাস্তা মাত্র চার ফুট। সিঁড়ির প্রস্থ আরও কম। অথচ এই বাড়িটিকেও ছাড়পত্র দিয়েছে দমকল, অন্তত এমনটাই দাবি বাড়ির মালিক এবং কেয়ারটেকার মুন্না পালের। বাড়ির হাল খারাপ হলেও তিনি জানান, অগ্নি-নির্বাপক ব্যবস্থা রয়েছে ওই বাড়িতে। কী ব্যবস্থা? মালিকের জবাব, “আগুন নেভানোর ফোমের দু’টো পোর্টেবল সিলিন্ডার।’’ তাই দেখেই মিলেছে ছাড়পত্র।
মধ্য কলকাতার ঠনঠনিয়া সংলগ্ন একটি অনুষ্ঠানবাড়িতে সোমবারও ছিল একটি বিয়ে। বাড়ির সামনের দরজা বেশ কিছুটা চওড়া। তার পরেই অত্যন্ত অপ্রশস্ত সিঁড়ি। লোকজনেরও আনাগোনা যথেষ্ট। এর মধ্যে যদি আগুন লাগে? বাড়িটির রক্ষণাবেক্ষণের এক কর্মী বলেন, “জানি না। আগুন নেভানোর কোনও ব্যবস্থা নেই এখানে।” বাড়ির মালিক মিশরিলাল স্বীকার করে নিয়েছেন, দমকলের কোনও ছাড়পত্র নেননি তিনি। তাঁর দাবি, বাড়িটি নেহাতই ছোট। তাই সেটির জন্য ছাড়পত্র নেওয়ার বিষয়ে বিশেষ আগ্রহ দেখাননি তিনি।
এগুলি কোনও বিচ্ছিন্ন উদাহরণ নয়। উত্তর থেকে দক্ষিণ, শহরের যে কোনও এলাকাতেই এমন অনুষ্ঠান বাড়ির খোঁজ মিলবে, যেগুলি কার্যত এক-একটি জতুগৃহ। শহরবাসীর ক্ষোভ, এ ভাবেই চলছে ব্যবসা। দায়ে পড়ে মানুষ ভাড়া নিচ্ছেন বাড়িগুলি। কিন্তু সব জেনেশুনেও প্রশাসন চুপ কেন, তা বোঝা যাচ্ছে না। এই সব বাড়ির মালিকদের অনেকেরই দাবি, তাঁরা বাড়ি ভাড়া দেওয়ার জন্য ছাড়পত্র নিয়েছেন দমকলের। কী শর্তে তাঁদের দমকল ছাড়পত্র দিয়েছে, তার অবশ্য কোনও ব্যাখ্যা নেই তাঁদের কাছে। কেউ আবার ধার ধারেননি দমকলের অনুমতির। ঠনঠনিয়ার অনুষ্ঠানবাড়িতে আসা এক যুবকের বক্তব্য, “আগুন লাগার কথা ছেড়ে দিন। কিছু ঘটলে এখানে হুড়োহুড়িতে পায়ের চাপেই মরতে হবে কয়েকশো মানুষকে।” |
আমরি-কাণ্ডের পর শহরের বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালের অগ্নি-সুরক্ষা নিয়ে নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসন। কিন্তু এ শহরের অনুষ্ঠান বাড়িগুলি নিয়ে কার্যত ‘নীরব’ দমকল-সহ প্রশাসনের উচ্চকর্তারা। অভিযোগ, এই বাড়িগুলির অধিকাংশের ফায়ার লাইসেন্স দূর অস্ৎ, নামমাত্র সুরক্ষার ব্যবস্থাও নেই।
দমকল সূত্রের খবর, শহরে অনুষ্ঠানবাড়ি ভাড়া দিতে গেলে ‘ফায়ার লাইসেন্স’ বাধ্যতামূলক। এ নিয়ে ‘ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড’-এ বিস্তারিত নিয়মও রয়েছে। কী রয়েছে তাতে? দমকলের ডেপুটি ডিরেক্টর বিভাস গুহ বলেন, “এই ধরনের বাড়িতে অন্তত দু’টি সিঁড়ি এবং তা পরস্পরের বিপরীত দিকে রাখতে হবে। বাড়ির উপরে বা নীচে পর্যাপ্ত জলের ব্যবস্থা রাখতে হবে। সেই জলাধার থেকে পাইপের মাধ্যমে প্রতিটি তলায় জল সরবরাহ করতে হবে। অনুষ্ঠানবাড়িতে এসি থাকলে ‘স্মোক ডিটেক্টর’ ও বিপদঘণ্টি বসাতেই হবে।”
অথচ, শহরে বেশির ভাগ অনুষ্ঠানবাড়ি চলছে এই সব নিয়ম না মেনেই। প্রশ্ন উঠেছে, নিয়ম না মানলে কী ভাবে মিলল ছাড়পত্র।
দমকলের এক কর্তার বক্তব্য, শহরের হাতেগোনা কয়েকটি অনুষ্ঠান বাড়ির ছাড়পত্র রয়েছে। বাকিগুলির অধিকাংশেরই ছাড়পত্র নেই। কয়েকটির ক্ষেত্রে রয়েছে প্রভিশনাল সার্টিফিকেট। কিন্তু শহরের অনুষ্ঠানবাড়িগুলি বৈধ না অবৈধ ভাবে চলছে, তা দেখার লোকবল বা পরিকাঠামোই দমকলের নেই বলে কবুল করেন ওই কর্তা। ফলে তাঁরা যে ওই বাড়িগুলি পরিদর্শনও করে উঠতে পারেন না, তা-ও মেনে নিয়েছেন তিনি।
|