জাতীয় বিধি মেনে বাড়ি, কঠোর মুখ্যমন্ত্রী
কেন্দ্রীয় সরকারের তৈরি ‘ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড’ বা জাতীয় গৃহনির্মাণ বিধি অবিলম্বে সর্বস্তরে যথাযথ ভাবে কার্যকর করতে কড়া নির্দেশ দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
বহু বছর আগেই যে বিধি তৈরি করেছিল কেন্দ্রীয় সরকার, তা এ রাজ্যে কেন এত দিন ধরে ঠিকঠাক ভাবে কার্যকর করা হয়নি, সেই প্রশ্ন তুলে মমতা জানিয়েছেন, এখনই শহরের সব বহুতল, হাসপাতাল, সিনেমা হল, শপিং মলে এই নির্দেশিকা মেনে ব্যবস্থা নিতে হবে। এলাকা ধরে ধরে এই ব্যবস্থা প্রয়োগ করার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি, যাতে পুরসভারও দায়িত্ব রয়েছে।
আমরি অগ্নিকাণ্ডের পরে ৪৮ ঘণ্টা কাটার আগেই মমতা রাজ্য প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে সমস্ত বিধি পর্যালোচনা করা হয়, তা দেখতে হবে। এবং কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের নির্দেশাবলী যাতে কোনও ভাবেই লঘু না হয়, সে ব্যাপারে প্রয়োজনে কঠোরতম ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সাধারণত এই কেন্দ্রীয় বিধিকে বিভিন্ন রাজ্য নিজেদের মতো কিছুটা অদলবদল করে ব্যবহার করে থাকে। পশ্চিমবঙ্গেও বামফ্রন্ট জমানাতেই এই নির্দেশিকা গ্রহণ করা হয়েছিল। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, বহু ক্ষেত্রেই কেন্দ্রীয় আইনটি সঠিক ভাবে কার্যকর হয়নি।
‘ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৭০ সালে। তার পরে ১৯৮৩ সালে এটির পরিমার্জনা করা হয়। এরও পরে ’৮৭ এবং ’৯৭ সালে মোট তিনটি খুব গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী করা হয়। শেষ পর্যন্ত ২০০৫ সালে শ’চারেক বিশেষজ্ঞের মত নিয়ে বিধিটি চূড়ান্ত করা হয়, যা এখন ‘এনবিসি ২০০৫’ নামে পরিচিত। আলাদা করে শুধু হাসপাতাল নয়, দেশজুড়ে পূর্ত বিভাগ, স্থানীয় প্রশাসন বা বেসরকারি নির্মাণ সংস্থা কোনও বাড়ি তৈরি করলে, তাদের এই নির্দেশিকা মানার কথা। ১৯৯৭ সালে দিল্লিতে ‘উপহার’ সিনেমা হলে ভয়াবহ আগুন লেগেছিল। তাতে প্রায় ৬০ জনের মৃত্যু হয়েছিল। আহত হয়েছিলেন শতাধিক। এই অগ্নিকাণ্ডের পর ‘উপহার’ সিনেমা হলের মালিকদের গ্রেফতার করা হয়েছিল। তাঁদের হাজতবাসও হয়েছে। ‘উপহারের’ ঘটনার পর দিল্লি প্রশাসন ‘ন্যাশানাল বিল্ডিং কোড’ যথাযথ ভাবে প্রয়োগ করেছিল।
কলকাতার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রথম দিনেই প্রশাসন থেকে প্রশ্ন উঠেছিল, যখন তোদি-সহ আমরি-র কর্তারা আত্মসমর্পণ করেছেন, তখন তাঁদের গ্রেফতার করা উচিত হবে কি না। এই মুহূর্তে রাজ্যের যে আইন আছে, তাতে তাঁদের সরাসরি অভিযুক্ত করা উচিত হবে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। কারণ, তাঁরা সংস্থার মালিক হলেও হাসপাতাল পরিচালনার সরাসরি দায়িত্বে ছিলেন কিছু অফিসার। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী এ ব্যাপারে নরম মনোভাব দেখাতে রাজি হননি। বরং তিনি রাজ্য প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছেন, এত বড় মর্মান্তিক অগ্নিকাণ্ডের পর সরকার তদন্তের বিষয়টি কোনও ভাবে লঘু করবে না। দোষী ব্যক্তিদের কঠোরতম শাস্তি দিতে হবে। মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য, “ব্যক্তিগত ভাবে কারও বিরুদ্ধে কোনও বিরূপ মনোভাব আমার নেই। কিন্তু আইনগত ভাবে কেউ দোষী হলে তার বিরুদ্ধে তদন্ত হবেই। যেখানে এত মানুষের জীবন নিয়ে প্রশ্ন, সেখানে কোনও কারণে আমি আপস করতে পারব না।”
‘এনবিসি’ অনুসারে যে ব্যবস্থাগুলি হাসপাতালে থাকা উচিত ছিল, তার অধিকাংশই আমরি-তে ছিল না। হাসপাতাল থেকে শায়িত অবস্থায় রোগীদের বাইরে বার করতে যে নিরাপদ ঢাল বা র্যাম্প প্রয়োজন, তা ছিল না। ছিল না বেসমেন্ট বা ভূগর্ভস্থ ঘর থেকে ধোঁয়া বহুতলে যাতে না ঢুকতে পারে সে জন্য পৃথক ‘ডাক্ট’। বেসমেন্টের আলাদা ভেন্টিলেশন ছিল না। আগুন বা গরম ধোঁয়া রুখতে এয়ারকন্ডিশনে ‘ড্যাম্পার’ কাজ করেনি। আগুন বা ধোঁয়া জরিপে ‘স্মোক ডিটেক্টর’ কাজ করেনি। যে বিপদঘন্টি আগুন লাগলে সতর্ক করে, তা-ও কাজ করেনি। জল ছিটিয়ে আগুন নেভাতে স্বয়ংক্রিয় ‘স্প্রিঙ্কলার’ও কাজে দেয়নি। আগুন নেভাতে তালিম ছিল না হাসপাতালের কর্মীদেরও। অথচ ‘ন্যাশানাল বিল্ডিং কোড’-এ সমস্ত বিষয় থাকার কথা বলা হয়েছে।
মমতা বলেন, “অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়েই মানুষ শিক্ষালাভ করেন। কলকাতা শহরে সমস্ত সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল, সমস্ত বড় বড় বাড়িতে অগ্নি-প্রতিরোধে যথোচিত ব্যবস্থা আছে কি না, তা খতিয়ে দেখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।” তিনি জানিয়েছেন, বহুতল বাড়ির আইন থেকে শুরু করে দমকলের বিধি প্রতিটি নিয়ম মানা হচ্ছে কি হচ্ছে না, সেগুলি তো খতিয়ে দেখা হবেই। তা ছাড়া নতুন হাসপাতাল, নতুন বহুতলে এনবিসি-র সব নির্দেশ মানা হচ্ছে কি না, সেটাও দেখতে হবে। মমতা চান, বহুতল, হাসপাতাল বা শপিং মল থেকে বাইরে বেরনোর অন্তত ৮-৯টা পথ থাকা প্রয়োজন। থাকা দরকার উদ্ধারের যাবতীয় ব্যবস্থা। সে ব্যাপারে কড়া নজর রাখতে তিনি কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়কে নির্দেশ দিয়েছেন। তাঁর নির্দেশ, সব কিছু দেখে তবেই যেন নতুন বাড়ির অনুমতি দেওয়া হয়। মমতা ভাল ভাবেই জানেন, সরকারি বাড়ির ক্ষেত্রে এই ব্যবস্থা কার্যকর করতে গেলে আরও অর্থের প্রয়োজন। সে জন্য কেন্দ্রের আর্থিক সাহায্য প্রয়োজন বলেও উল্লেখ করেন তিনি। একই সঙ্গে বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য যে আরও পুলিশকর্মী দরকার, সে কথা জানিয়ে তার জন্য বাড়তি কেন্দ্রীয় অনুদানের কথাও বলেন তিনি।
আমরি-র ঘটনায় টনক নড়েছে কেন্দ্রীয় সরকারেরও। কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন মন্ত্রী কমল নাথ বলেন, “এনবিসি সর্বস্তরে মানা হচ্ছে কি না, কলকাতার ঘটনার পরে প্রতিটি রাজ্যকে তা অবিলম্বে খতিয়ে দেখতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ‘ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট’ বা বিপর্যয় মোকাবিলা ব্যবস্থা তো ঘটনার পর কাজে লাগে। কিন্তু দুর্ঘটনা যাতে না হয়, তার জন্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা আরও জরুরি। আমরি-র ঘটনার পর প্রতিটি রাজ্যকে তাই এমন কোনও দুর্ঘটনা আগাম সামলাতে সতর্কবার্তা পাঠানো হয়েছে।” মমতা যে ক্ষিপ্রতায় ঘটনাস্থলে পৌঁছে, দীর্ঘ সময় সেখানে থেকে এবং সকলকে সঙ্গে নিয়ে ঘটনার মোকাবিলা করেন, তা প্রশংসার যোগ্য বলেই বক্তব্য কমল নাথের। তিনি বলেন, “মমতার বিপর্যয় মোকালিবার এই মডেলকেই কেন্দ্র অনুসরণ করতে চায়। সব রাজ্যকে সে ব্যাপারে বার্তাও দেওয়া হচ্ছে।”
একই সঙ্গে এই ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গের সব রাজনৈতিক দল যে ভাবে নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, তা-ও তাঁদের নজর কেড়েছে বলেও জানিয়েছেন গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী।

এই সংক্রান্ত আরও খবর
ফেল সেই সেপ্টেম্বরে, স্বীকৃতি কাড়ে কেন্দ্রীয় সংস্থা



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.