|
|
|
|
মমতাকে কুর্নিশ এ বার টাটারও |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
তিন বছর আগের ‘ব্যাড এম’ বদলে গেল ‘গুড এম’-এ!
সিঙ্গুর থেকে ছোট গাড়ির কারখানা গুটিয়ে গুজরাতের সানন্দে চলে যাওয়ার সময় যাঁকে দুষে বিবৃতি দিয়েছিলেন, আমরি-কাণ্ডে মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে তাঁর ভূমিকাকেই কুর্নিশ জানালেন সেই রতন টাটা। ‘ব্যাড এম’ বলার সময় নাম করেননি। আমরি-কাণ্ডেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম না-করেই টাটা গোষ্ঠীর কর্ণধার ট্যুইট করেছেন, ‘মুখ্যমন্ত্রীর দ্রুত ও দৃঢ় পদক্ষেপ প্রশংসনীয়’।
সিঙ্গুর-পর্বকে ঘিরে টাটা এবং মমতার সম্পর্ক এ রাজ্যের প্রেক্ষিতে এমনই চর্চার বিষয় যে, ওই ট্যুইট যথেষ্ট চাঞ্চল্য এবং জল্পনার কারণ হয়ে দাঁড়ানো স্বাভাবিক। টাটার মন্তব্যে রাজনীতির কোনও লেশ নেই। মুখ্যমন্ত্রীর যে ভূমিকার তিনি প্রশংসা করেছেন, তা নিয়েও কোনও মহলে কোনও সংশয় নেই। তবু প্রশংসা করছেন রতন টাটা, প্রাপক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই অনুষঙ্গই যথেষ্ট তাৎপর্য এবং জল্পনার বিষয়। বিশেষত, তা-ও এমন এক সময়ে, যখন সিঙ্গুরে টাটার কারখানার জমি মমতার সরকার অধিগ্রহণ করে নেওয়ায় আদালতে মামলা চলছে।
এ সবই অবশ্য জল্পনার প্রতিপাদ্য। শিল্প মহলের ব্যাখ্যা, টাটার মন্তব্যে মমতার নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকারের সঙ্গে কোনও সমঝোতার প্রয়াস নেই। সে আপাতদৃষ্টিতে তাঁর কথায় যা-ই মনে হোক না কেন। শিল্প মহলের যুক্তি, রতন টাটা শুধু ভারতেই নন, গোটা বিশ্বে এক জন প্রথম সারির শিল্পপতি হিসেবে স্বীকৃত। আর আমরি-র ঘটনার মতো নজির পৃথিবীর ইতিহাসেও বিশেষ নেই। স্বাভাবিক ভাবেই এক জন ‘সংবেদনশীল নাগরিক’ হিসেবে সেই বৃহত্তর ট্র্যাজেডির প্রেক্ষাপট থেকেই মত দিয়েছেন টাটা গোষ্ঠীর শীর্ষ কর্তা।
সিঙ্গুরে তুঙ্গ বিবাদের পরে আরও কিছু রাজনৈতিক দলের মতো তৃণমূরে নির্বাচনী তহবিলে অনুদান দিতে চেয়েছিল টাটা গোষ্ঠী। তৃণমূল নেত্রী মমতা সেই চেক ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতাও টাটার এ বারের অভিবাদনের কথা জেনে মুখ খোলেননি। বরং, তিনি নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন আমরি-কাণ্ডের শোকজ্ঞাপনে এবং উদ্ধারকারীদের কৃতিত্বের স্বীকৃতিতে। আজ, সোমবারই বেলা ১২টায় রবীন্দ্র সরোবর সংলগ্ন সাফারি পার্কে আমরি-কাণ্ডে মৃতদের স্মৃতিতে নির্মিত অস্থায়ী স্মারকে শ্রদ্ধা জানাবেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর কথায়, “বহু মানুষ আসছেন শোক জ্ঞাপন করতে। ওই জায়গাটা ঢাকুরিয়া আমরির কাছে বলেই অস্থায়ী ভাবে ওখানে স্মারক বসানোর ব্যবস্থা হয়েছে। পরে ও’টি স্থায়ী করা হবে।”
সারা দিনের কর্মসূচির পরে আজই রাত ৮টায় বিড়লা তারামণ্ডল থেকে ময়দানে গাঁধী মূর্তির পাদদেশ পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি শোকমিছিল হবে। মিছিলের শেষে হবে প্রার্থনা-সভাও। মমতা মিছিলের নামকরণ করেছেন ‘দুঃখের শিখর চূড়ে’। শুধুই শোকপালন নয়, আমরি-কাণ্ডে পঞ্চাননতলার যে স্থানীয় বাসিন্দারা উদ্ধার কাজে ছিলেন, কাল, মঙ্গলবার পুলিশের একটি অনুষ্ঠানে তাঁদের সংবর্ধনার ব্যবস্থাও করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। পাশাপাশি, আজ পার্ক স্ট্রিটের অ্যালেন পার্কে কলকাতা আর্চ বিশপ হাউসের তরফে একটি প্রার্থনা-সভায় মৃতদের স্মৃতির উদ্দেশে মোমবাতি জ্বালানো হবে।
তথ্যের খাতিরে উল্লেখ্য, অগ্নিকাণ্ড এবং তার জেরে বিষাক্ত ধোঁয়ায় ঢাকুরিয়ার আমরি হাসপাতালে ৯০ জনের (ঘটনার দিন এবং পরে মৃতদের ধরে) মৃত্যুর দিন ঘটনাস্থলে উদ্ধারকার্য তদারকিতে পৌঁছেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। এসএসকেএম হাসপাতালের মর্গের সামনে বসে থেকে পরিজনদের স্বার্থে হ্যান্ডমাইক নিয়ে ঘোষণা করছেন মুখ্যমন্ত্রী, একই সঙ্গে জনতার ক্ষোভ সামলাতে ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়েই জানিয়ে দিচ্ছেন অভিযুক্তদের গ্রেফতার করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এ দেশের কোনও রাজ্যেই এমন দৃশ্য স্মৃতিতে নেই। শুধু ময়নাতদন্ত দ্রুত করানোই নয়, তার পরে মৃতদেহগুলি ফেরত পাঠানোর দিকেও খেয়াল রেখেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর নির্দেশে তৃণমূল বিধায়ক অরূপ বিশ্বাস ১০০টি শববাহী গাড়ি জোগাড় করে ফেলেছিলেন বিভিন্ন সংগঠন ও ক্লাব মারফত।
এই ‘তৎপর’ মমতার ভূমিকাকেই সেলাম জানিয়েছেন টাটা। মুখ্যমন্ত্রীর ‘দ্রুত ও দৃঢ় পদক্ষেপ’ প্রশংসনীয় বলার সঙ্গে সঙ্গেই গোটা ঘটনায় সমবেদনা ও শোকজ্ঞাপন করেছেন। হাসপাতালের কড়া ভাষায় সমালোচনাও করেছেন। তাঁর বক্তব্য, যে ভাবে রোগীদের মৃত্যু হয়েছে, তা নিন্দনীয় এবং ক্ষমার অযোগ্য। আমরি-কাণ্ডে ক্ষুব্ধ আম জনতার মতোই টাটা বলেছেন, ‘রোগীদের জীবনরক্ষাই সব হাসপাতালের প্রাথমিক কর্তব্য। অতিরিক্ত মুনাফা নয়’। প্রসঙ্গত, টাটা গোষ্ঠীও ক্যানসার হাসপাতাল চালায়। টাটার বক্তব্যকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন রাজ্যের প্রথম সারির এক শিল্প-কর্তা। তাঁর মতে, হাসপাতাল মুনাফা করতেই পারে। তবে সেই অর্থ লগ্নি করতে হবে হাসপাতালের উন্নয়নেই। আর ‘অতিরিক্ত মুনাফা’ কখনওই নয়।
বিপর্যয়ের সময় রোগীদের পাশে না-থাকার যে অভিযোগ কর্মী ও চিকিৎসকদের একাংশের বিরুদ্ধে উঠেছে, সেই প্রসঙ্গে টাটা’র মন্তব্য, ‘ওই পরিস্থিতিতে এটা অবিশ্বাস্য! এবং নিন্দনীয়। সযত্ন রোগীদের সুস্থ করে তোলাই প্রত্যেক চিকিৎসক ও কর্মীর মূল কর্তব্য’। তবে রোগীদের বাঁচাতে গিয়ে হাসপাতালের যে তিন কর্মীর মৃত্যু হয়েছে, তাঁদের কুর্নিশ জানাতেও কার্পণ্য
করেননি। তাঁদের ও মৃত রোগীদের পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন।
শিল্প মহলও তাই শুধু একটি ঘটনার সমালোচনা বা মুখ্যমন্ত্রীর প্রশংসা কোনও একটি দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি দেখতে নারাজ। বরং, সার্বিক ভাবে সামাজিক অবক্ষয় ও মানুষের অসহায়তার বার্তাই টাটা দিতে চেয়েছেন বলে তারা মনে করছে। এক বণিকসভার কর্তার মতে, “উনি যা বলেছেন, সকলেই তো তা-ই বলছেন! ঘটনাস্থলে মুখ্যমন্ত্রীর উদ্যোগকে সবাই সাধুবাদ জানিয়েছেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বা চিকিৎসক-কর্মীদের একাংশের আচরণও সকলকে বিস্মিত করেছে। টাটাও সেই বৃহত্তর প্রেক্ষিত থেকেই তাঁর মনের কথা অকপটে বলেছেন। এর সঙ্গে অন্য বিষয়ের অর্থ খোঁজা ঠিক নয়।”
আর এক বণিকসভার কর্তার মতে, টাটা ‘সংবেদনশীল’ এবং ‘বড় মনের মানুষ’। ওই কর্তার কথায়, “শুধু শিল্প মহল নয়, তিনি কী বলছেন, তার দিকে তাকিয়ে থাকে গোটা বিশ্বই। তিনি এক জন ভারতীয়ও। ফলে, দেশের কোনও ঘটনা তাঁকে নাড়া দিতেই পারে। সে রকম ঘটনা থেকে সুবিধা নেওয়ার মানুষ তিনি নন।”
টাটার মন্তব্যে কারও মনে পড়ছে নয়ের দশকে জামশেদপুরে টাটা স্টিলের প্রতিষ্ঠা দিবসের অনুষ্ঠানে অগ্নিকাণ্ডের ভয়াবহতার কথা। স্মৃতিতে টাটকা রয়েছে মুম্বইয়ের তাজ হোটেলে জঙ্গি হামলাও। যেখানে অতিথিদের রক্ষা করতে গিয়ে হোটেলের কর্তাকে হারাতে হয়েছিল তাঁর দুই পুত্র ও স্ত্রীকে। অনেকে মনে করিয়ে দিচ্ছেন টাটা গোষ্ঠীর নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডের কথা। একই সঙ্গে উঠে আসছে সিঙ্গুরের ঘটনার পরেও এ রাজ্যে ক্যানসার হাসপাতাল তৈরি ও ভবিষ্যতে তার সম্প্রসারণ নিয়ে টাটার উদ্যোগের কথাও। সিঙ্গুরকে ঘিরে তিক্ত অনুষঙ্গে টাটার ট্যুইটকে জড়াতে চাইছে না শিল্প মহল। বৃহত্তর প্রেক্ষিতে টাটার ‘মানসিক যন্ত্রণা’র বহিঃপ্রকাশকেই গুরুত্ব দিতে আগ্রহী তারা।
রাজনৈতিক শিবিরও আমরি-কাণ্ড নিয়ে তৎপর। ময়দানে যুব তৃণমূলের আজকের সমাবেশ আমরি-র ঘটনার জন্য ৭ দিন স্থগিত রাখা হয়েছে। দলনেত্রী মমতার ‘নির্দেশে’ই তাঁদের কর্মসূচি ১৯ ডিসেম্বর হবে বলে জানিয়েছেন যুব তৃণমূলের রাজ্য সভাপতি ও তমলুকের সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী। দক্ষিণ কলকাতা জেলা কংগ্রেস সভানেত্রী মায়া রায়ের নেতৃত্বে এ দিনই দেশপ্রিয় থেকে গোলপার্ক পর্যন্ত মোমবাতি নিয়ে মৌনী মিছিল হয়েছে।
|
|
|
|
|
|
|