সংবাদপত্রের প্রথম পৃষ্ঠার বড় খবরের চাপে অনেক সময়ে ভিতরের ছোট খবর ঢাকা ও চাপা পড়িয়া যায়। আয়তনে ক্ষুদ্র হইলেও সমাজের চেহারা বুঝিবার জন্য এই ছোট-ছোট খবরগুলি খেয়াল করা প্রয়োজন। বিন্দুতে সিন্ধুদর্শন কথাটি মূল্যবান। সম্প্রতি পুরুলিয়া জেলার গোপালমোড় এলাকার ঊনবিংশতি বর্ষীয়া এক কন্যা অসম সাহসের পরিচয় দিয়াছেন। এই মেয়েটির বাবা একটি চায়ের দোকান চালান। স্বভাবতই এ সকল ক্ষেত্রে যাহা হয়, এখানেও তাহা ঘটিয়াছিল। দরিদ্র মেয়েটি পড়া ছাড়িয়া দিয়াছিল, তাহার বাবাও কন্যার বয়স উনিশ হইতে না হইতেই পাত্র জোটাইয়া ছিলেন। কন্যাকে বিবাহ দিয়া দায়মুক্ত হইবেন ইহাই উদ্দেশ্য। দরিদ্র পরিবারের পিতার এমন বাসনা অনিবার্য ও স্বাভাবিক। পাত্র পক্ষের নিকট এ সকল ক্ষেত্রে কন্যাকর্তা দীন-হীন হইয়া থাকেন, বরপক্ষ ও বরযাত্রীদের জুলুম খানিক মানিয়া চলেন। ইহা চলিয়া আসিতেছে। রবীন্দ্রনাথের ‘যজ্ঞেশ্বরের যজ্ঞ’ নামক গল্পে জুলুমবাজ বরযাত্রীদের চিত্র আছে। এ কালেও যে এ রূপ যজ্ঞনাশকারী মূর্তিমান বরযাত্রীদের দেখা মেলে, পুরুলিয়ার ঘটনায় তাহা টের পাওয়া গিয়াছে। অভিযোগ উঠিয়াছে, বরযাত্রীরা ভাত কিছু কম পড়ায় নাকি অভব্যতার সীমা ছাড়াইতে দ্বিধা করেন নাই। বরপক্ষ বা পুরুষপক্ষ বলিয়া কথা! তবে এ কালের মেয়েরা আর সে কালের মেয়েদের মতো চুপ করিয়া থাকিতে নারাজ। পুরুলিয়ায় কনেটি ‘লগ্নভ্রষ্টা হইতে হইবে’ জাতীয় সংস্কারের তোয়াক্কা না করিয়া বিবাহে বাধ সাধিয়াছেন। এমন বরযাত্রীদের সঙ্গে করিয়া আনিয়াছেন যিনি, সেই পাত্রকে বিবাহ করিতে যে তিনি নারাজ, সেই কথাটি তিনি স্পষ্ট ভাবে জানইয়া দিয়াছেন। সামাজিক সংস্কারের ভয়ে নির্বাক হইয়া সহ্য করিবার সহজ পথটি গ্রহণ করেন নাই। এহ বাহ্য। শুধু এই বিবাহ না করিবার সিদ্ধান্ত গ্রহণেই তিনি থামিয়া থাকেন নাই, পুনরায় পড়াশোনা শুরু করিবার সঙ্কল্পের কথা ব্যক্ত করিয়াছেন।
নাগরিক জীবনে যে ভারতবর্ষ প্রকটিত ও প্রকাশিত, সেখানে মেয়েরা অর্থনৈতিক ভাবে অনেকটাই স্বাধীন। কিন্তু জেলার চিত্র ভিন্ন। সেখানকার মেয়েদের জীবনে স্বাধীনতার সীমা ভিন্ন প্রকার। বিবাহই যেন সেই সব অঞ্চলে এখনও অবধি মেয়েদের ভবিতব্য। এই বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠান মেয়েদের যৌন সম্পত্তি হিসাবে দেখিতে চায়। পরাধীন, উপার্জনে অক্ষম মেয়ের বিবাহ দিয়েই পিতা খালাস। তাহার পর সব মেয়েটির ‘কপাল’। পুরুলিয়ার মেয়েটি এই প্রবণতার বিরোধিতা করিয়াছে। এ জন্যই তাহার সাহস সাধুবাদ যোগ্য। মনে রাখা দরকার, অনেকে চাহিলেও সাহস করিয়া মনের কথা প্রকাশ করিতে ভয় পায়। সমাজ ও পুরুষতন্ত্রের প্রতি ভীতি হইতেই এই মৌন নিয়ম হইয়া উঠিয়াছে। এই মৌনকে প্রতিবাদের মাধ্যমে অতিক্রম করিতে হইবে। এ জন্য জনমত গড়িয়া তোলা দরকার। এ ক্ষেত্রে যাহারা এই ব্যবস্থার শিকার, তাহাদের, অর্থাৎ মেয়েদের সচেতন করিয়া তুলিতে হইবে। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার এ বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করিয়াছেন। প্রত্যন্ত অঞ্চলের যে সমস্ত সাহসী মেয়ে বিবাহ নামক নিরুপায় পিতৃতান্ত্রিক সামাজিক শৃঙ্খলের শিকার না হইয়া, নিজেরা পড়াশোনা করিতে উদ্যোগী হইয়াছে, সরকারের পক্ষ হইতে তাহাদের উৎসাহ দেওয়া হইতেছে। তাহাদের আলাদা ভাবে চিহ্নিত করা হইতেছে। মেয়েরা এক মত, এক জোট হইয়া বৃহত্তর সামাজিক কার্যে সংযুক্ত হইলে ইহাকে আর বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসাবে গ্রহণ করা হইবে না। এই সমস্ত ঘটনা তখন শিরোনাম হইবে। সচেতন, স্বনির্ভর ভারত গড়িয়া উঠিবে। |