মগরাহাটে পুলিশের গুলিচালনায় মৃত্যুর ঘটনা লইয়া বিচারবিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ আসিয়াছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের নির্দেশ। মানবাধিকার কমিশনের নির্দেশ মানিয়া সি আই ডি তদন্তও চলিবে। মুখ্যমন্ত্রী জানাইয়াছেন, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা বজায় রাখিবার স্বার্থেই এক অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে দিয়া তদন্ত করাইবার সিদ্ধান্ত। উদ্দেশ্যটি সাধু। সত্য উদ্ঘাটন। সেই সত্যে পৌঁছাইবার পদ্ধতি লইয়া একটি প্রশ্ন উঠিতে পারে। প্রশ্নটি নিতান্তই নীতিগত, এবং সেই সূত্রে পদ্ধতিগত। ইহার সহিত কোনও ব্যক্তিবিশেষের দক্ষতা বা অদক্ষতার কোনও সম্পর্ক নাই। যে বিচারপতিকে দিয়া তদন্তটি করাইবার সিদ্ধান্ত হইয়াছে, তাঁহার যোগ্যতা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলিবার কারণ নাই, তাহা আবশ্যকও নহে। কথা হইল, কর্মরতই হউন বা অবসরপ্রাপ্ত, কোনও বিচারপতি এই জাতীয় তদন্ত করিবেন কেন? তাঁহার দক্ষতার ক্ষেত্রটি ভিন্ন। সেই ক্ষেত্রে তাঁহার যোগ্যতা থাকিতেই পারে। মগরাহাটে সে দিন যথার্থই কী হইয়াছিল, পুলিশ কেন এবং কী রূপে গুলি চালাইয়াছিল, তাহা সম্যক ভাবে সন্ধান করিবার জন্য কোনও প্রশাসন-বিশেষজ্ঞকেই নির্বাচন করা যাইত। যাঁহারা নিজস্ব জীবনে এই ধরনের সংকটের মোকাবিলা করিয়াছেন, তাঁহারাই পরিস্থিতিটি যথার্থ উপলব্ধি করিতে পারিবেন। তাহা হইলে বিচারপতি কেন?
উত্তরটি সুবিদিত। কোনও তদন্তের সূত্রে যখন প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা প্রদর্শন আবশ্যক হয়, তখনই বিচারবিভাগীয় তদন্তের কথা উঠে। কার্যক্ষেত্রে ইহা এক প্রকার অলিখিত বিধির ন্যায় বিদ্যমান। বিচারবিভাগ ব্যতীত অন্য কেহই যথার্থ রূপে নিরপেক্ষ হইতে পারেন না, এমন একটি ধারণা জনমানসে হাজির। ফলে, কোনও সংকট উপস্থিত হইলে সকল পক্ষই নিয়ম করিয়া বিচারবিভাগীয় তদন্তের কথা বলেন। অথচ, ইহা যে এক অর্থে প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা এবং প্রকৃতপক্ষে তাহার দক্ষতার প্রতি অনাস্থা প্রকাশের শামিল, সেই জরুরি কথাটি বিবিধ কোলাহলের ভিতর ডুবিয়া যায়। প্রশাসন তৃতীয় পক্ষের উপর তদন্তের ভার ন্যস্ত না করিয়া যদি নিজেরাই প্রকৃত সত্য উন্মোচন করিতে পারে, তাহাই কাম্য। তাহা নিরপেক্ষতা প্রদর্শনের পরাকাষ্ঠাও বটে। সমস্যা হইল, জনগণ এবং রাজনীতিকদের যুগ্ম মানসপটে সেই সক্রিয় নিরপেক্ষতায় চিড়া ভিজে না। যথাসম্ভব নিষ্ক্রিয় থাকাই সাধুতার মুখচ্ছবি হইয়া উঠে।
মগরাহাটের কাণ্ডে অবশ্য আরও একটি জরুরি প্রশ্ন উপস্থিত। বেআইনি বিদ্যুৎ বণ্টন রুখিবার কী হইবে? যে সকল মৃত্যুর ঘটনা ঘটিয়াছে, তাহা অতীব দুঃখজনক। কোনও ভাবেই তাহার কোনও পুনরাবৃত্তি কাম্য নহে। আবার, ‘হুকিং’ নামক অপকর্মটিও অতীব অবাঞ্ছিত। সত্য, এমন একটি কাণ্ড ঘটিয়া যাইবার অব্যবহিত পরে কোনও কঠোর বন্দোবস্ত গ্রহণ করা কঠিন। স্পর্শকাতর এলাকায় হয়তো এই মূহূর্তে তাহা বাঞ্ছিতও নহে। কিন্তু, তাই বলিয়া একটি অবাঞ্ছিত ঘটনা আসিয়া যদি নিত্যকার একটি অন্যায়কে ঢাকিয়া দেয়, তাহাই আদপেই কাম্য হইবে না। ইহার ফলে একটি প্রশাসনিক গাফিলতি হইতে দীর্ঘকালের একটি অন্যায় প্রশ্রয় পাইতে পারে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘হুকিং’ বন্ধের প্রসঙ্গে জানাইয়াছেন যে তাহা পরে হইবে। পরে হইলেও যেন কাজটি হয়, তাহা নিশ্চিত করিবার দায়িত্ব তাঁহারই। হুকিং নামক এই নৈরাজ্য দীঘর্কাল ধরিয়া পশ্চিমবঙ্গের বিদ্যুৎ ক্ষেত্রের ব্যাধি। পরিভাষায় যাহাকে ‘জিরো টলারেন্স’ বলে, ‘হুকিং’ বিষয়ে সেই ধরনের মনোভাব গ্রহণই জরুরি। মগরাহাটে সে দিন কী ঘটিয়াছিল, সেই সত্য উদ্ঘাটনের মতোই জরুরি। মুখ্যমন্ত্রী একটি অন্যায়ের প্রতিকারে উদ্যোগী হইয়াছেন। আশা করা চলে, অন্য কর্তব্য হইতেও তিনি চ্যুত হইবেন না। |