ঘুমিয়ে পড়লেন ‘গাইড’। দেশ নয়, ‘পরদেশ’ লন্ডনে। টানা সাড়ে ছ’দশকের কর্মব্যস্ত জীবন থেকে ছুটি নিলেন দেব আনন্দ।
শরীর ভাল যাচ্ছিল না কয়েক দিন ধরে। তাই ডাক্তারি পরীক্ষা করাতে লন্ডনে গিয়েছিলেন ৮৮ বছরের ‘নায়ক’। ‘ওয়াশিংটন মেফেয়ার হোটেলে’ সঙ্গে ছিলেন ছেলে সুনীল। পরিবারের তরফে জানানো হয়েছে, গত কাল রাতে হোটেলে ঘুমের মধ্যেই হৃদ্রোগে আক্রান্ত হন দেব। অ্যাম্বুল্যান্সও ডাকা হয়েছিল। কিন্তু তখন আর কিছু করার ছিল না।
শেষকৃত্য হবে লন্ডনেই। ভারতীয়দের মনে দেব আনন্দের ‘চিরসবুজ’ ছবিটাই রেখে দিতে চাইছে তাঁর পরিবার। সম্ভবত সেই কারণেই মৃত নায়ককে তাঁর দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে না। দেব নিজেও নাকি তেমনই চেয়েছিলেন।
এক বার বলেছিলেন, নিজের জীবন-দর্শনটা তিনি সাজিয়েছেন তাঁরই ছবি ‘হাম দোনো’র গানের ওপর ‘ম্যায় জিন্দগি কা সাথ নিভাতা চলা গয়া’। আর দেব আনন্দকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অধিকাংশ ফিল্ম দর্শক বাঁধাধরা যে দু’তিনটে কথা বলেন, দেখা যায় সেই কথাগুলোর সঙ্গে গানটার অদ্ভুত মিল। দেব আনন্দ প্রাণপ্রাচূর্যে ভরপুর, কক্ষনো ‘না’ বলতে না শেখা একটা মানুষ। অভিনয়, প্রযোজনা, পরিচালনা যাঁর কাছে একটা নেশার মতো। যিনি বাণিজ্যিক সাফল্যের তোয়াক্কা না করে ৮৮ বছর বয়সেও সিনেমা বানিয়ে চলেন। ব্যক্তিগত-পেশাগত জীবনের ছোট-বড় ধাক্কা পেরিয়ে যিনি ‘জিন্দগি’র সঙ্গে নির্দ্বিধায় পথ হাঁটার সাহস রাখেন। বহু ব্যবহারে জীর্ণ আরও একটা শব্দবন্ধ তাঁর সঙ্গে এক রকম সমার্থকই হয়ে গিয়েছে। ‘এভারগ্রিন’ চিরসবুজ! যিনি জীবনের শেষ ছবিতেও কেন্দ্রীয় চরিত্র। নায়ক।
ধরম দেব পিশোরী আনন্দ। জন্ম ১৯২৩-এর ২৬ সেপ্টেম্বর, অবিভক্ত পঞ্জাব প্রদেশের গুরুদাসপুর জেলায়। তিন ভাই চেতন, দেব আর বিজয়। তিনি মেজো। বোন শীলাকান্তা কপূর (পরিচালক শেখর কপূরের মা)। লাহৌর গভর্নমেন্ট কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক হয়ে দেব চলে আসেন মুম্বই। চার্চগেটে সেনাবাহিনীর সেন্সর অফিসে ১৬০ টাকা মাইনের চাকরি। সেখানেই দাদা চেতনের প্রভাবে জড়িয়ে পড়লেন ‘আইপিটিএ’-তে। আর এ সবের ফাঁকেই ডাক এল ‘প্রভাত টকিজ’ থেকে। ১৯৪৬। প্রথম ছবি ‘হম এক হ্যায়’। দু’বছরের মধ্যেই প্রথম ‘ব্রেক’। অশোককুমার নিয়ে এলেন
বম্বে টকিজে। সেই ‘জিদ্দি’ (১৯৪৮) ছবিতে নায়ক দেব আনন্দ, আর তাঁর গলাতেই এই প্রথম বার কোনও ছবিতে প্লে-ব্যাক করলেন কিশোরকুমার।
আর ফিরে তাকাতে হয়নি। ১৯৪৯ সালেই গড়ে ফেললেন নিজের প্রযোজনা সংস্থা ‘নবকেতন’। সেই নবকেতন প্রযোজিত ও বন্ধু গুরু দত্ত পরিচালিত ‘বাজি’ ছবিতেই দেবের সঙ্গে প্রথম বার অভিনয় করলেন কল্পনা কার্তিক। পরবর্তী কালে যিনি হবেন দেবের জীবনসঙ্গিনী। কল্পনার আগে অবশ্য দেবের জীবনে এসেছিলেন অভিনেত্রী সুরাইয়া। একসঙ্গে কাজ করতে করতেই দু’জনের প্রেম। পরিবারের আপত্তিতে পরিণতি পায়নি সে সম্পর্ক। তবে খ্যাতির দাঁড়িপাল্লায় সুরাইয়ার পাশে প্রথম দিকটায় যেন কতকটা পিছিয়েই ছিলেন দেব। জমিটা শক্ত হতে থাকে ‘সিআইডি’, ‘পেয়িং গেস্ট’, ‘হাউস নম্বর ৪৪’, ‘হাম দোনো’-র মতো ছবিগুলো থেকে। ট্রেডমার্ক’ একপেশে হাসি, ঢুলুঢুলু চোখে ঘাড় কাত করা, এক পাশে ঝুঁকে হাঁটাচলা নকল করার প্রতিযোগিতা পড়ে যায় ভক্তমহলে। অনেকে আবার হলিউডের নায়ক গ্রেগরি পেকের ছায়াও দেখতে পান তাঁর মধ্যে। ষাটের দশক থেকেই দেব পুরোদস্তুর রোম্যান্টিক নায়ক। তাঁর ‘কণ্ঠ’ কখনও মহম্মদ রফি, কখনও কিশোরকুমারের। হসরত জয়পুরী, মজরুহ সুলতানপুরী, শৈলেন্দ্র বা আনন্দ বক্সীর লেখা গানে শঙ্কর-জয়কিষণ, ও পি নাইয়ার, শচীন দেববর্মণ বা রাহুল দেববর্মণের সুর। দেব আনন্দের ছবি মানেই একঝাঁক সুপারহিট গান। |
ভোপালে স্মরণ। ছবি: পিটিআই |
‘সিআইডি’-র নায়িকা ওয়াহিদা রেহমানের সঙ্গেই তাঁর প্রথম রঙিন ছবি ‘গাইড’। পরিচালক ভাই বিজয় আনন্দ। এর পর ‘জুয়েল থিফ’, ‘জনি মেরা নাম’। ১৯৭০-এ প্রথম পরিচালনা ‘প্রেম পূজারী’। ঠিক পরের বছরেই ‘হরে রাম হরে কৃষ্ণ’। ঝড় তুলে দেন জিনত আমন। ঠিক এই সময়টাতেই দেবের সমসাময়িক রাজ কপূর, দিলীপকুমাররা নায়কের চরিত্র করা থেকে নিজেদের সরিয়ে নিচ্ছিলেন। দেব সে ‘নিয়ম’ মানেননি। ‘বনারসী বাবু’, ‘হীরা পান্না’, ‘দেশ পরদেশ’-এর মতো ছবিতে লাগাতার তিনিই নায়ক। নায়িকা কখনও জিনত, কখনও হেমা মালিনী, কখনও মুমতাজ, রাখি বা শর্মিলা ঠাকুর, আবার কখনও প্রায় ৩৫ বছরের ছোট টিনা মুনিম (সাদা-কালোর জমানায় সুচিত্রা সেনের সঙ্গেও দু’টো ছবিতে কাজ করেছেন)। জহুরি দেবের চোখ বারবার খুঁজে নিয়েছে সম্ভাবনাময় নায়ক-নায়িকাদের। এমনকী জ্যাকি শ্রফ আর টাবুরও বলিউডে আত্মপ্রকাশ তাঁর হাত ধরে। ছেলে সুনীলকে নায়ক করে ‘আনন্দ অওর আনন্দ’ নামে একটা ছবিও করেছিলেন। চলেনি। দেবের পরিচালিত আর কোনও ছবিই ‘হরে রাম হরে কৃষ্ণ’র মতো বক্স অফিস সাফল্য পায়নি। কিন্তু পরিসংখ্যানকে আর কবে তোয়াক্কা করেছেন দেব আনন্দ! ‘পদ্মভূষণ’ আর ‘দাদাসাহেব ফালকে’ পুরস্কারে সিনেমা জগতে তাঁর অবদান আর ভরপুর জীবনীশক্তিকে সম্মান জানিয়েছে দেশ। এই ২০১১-তেও দেব তৈরি করেছেন ‘চার্জশিট’। সেটাই শেষ ছবি। পুরোদস্তুর মার্কিন কলাকুশলীদের নিয়ে ‘সং অফ লাইফ’ নামে আরও একটা ছবির কাজ শুরুর কথা ভাবছিলেন বলেও খবর। তার আগেই থেমে গেলেন ‘গাইড’।
দিনভর নানা মহল থেকে এসেছে শোকবার্তা। সে তালিকায় যেমন অমিতাভ বচ্চন, রজনীকান্তরা রয়েছেন, তেমন রয়েছেন নরেন্দ্র মোদীও। ট্যুইটারে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী লিখেছেন, “বিনোদন দুনিয়ার গাইড প্রয়াত হলেন। জরুরি অবস্থার সময়ে তিনি অত্যন্ত প্রত্যয়ের সঙ্গে গণতন্ত্রের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন।” প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ বলেছেন, “অভিনয় ও পরিচালনার প্রতি ভালবাসার প্রতীক ছিলেন দেব আনন্দ।” শোকবার্তা দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি প্রতিভা পাটিল, লোকসভার স্পিকার মীরা কুমার। বলিউড তারকারা সকাল থেকে ট্যুইট করে চলেছেন।
গাইডকে খুঁজে চলেছে সবাই। গাইড ঘুমিয়ে পড়েছেন।
|
|
|
আমার প্রথম নায়ক।
আমি মজা করে বলতাম, দেব তুমি একদম এভারেডি ব্যাটারির মতো।
ওয়াহিদা রহমান |
|
|
মৃত্যুর সঙ্গে দেব সাহেবকে এক করা যায় না।
অমিতাভ বচ্চন |
|
|
জীবনে কখনও ফিরে তাকাননি। লতা মঙ্গেশকর |
|
|
বলিউডের সেই জাদুকরী শক্তিটাই আর রইল না। শাহরুখ খান |
|
|
দেব সাহেব পরবর্তী সব প্রজন্মের কাছে আইকন আমির খান |
|
|
|
তথ্য সহায়তা: লন্ডন থেকে শ্রাবণী বসু |