কৌশলগত ভাবে সরে আসতে বাধ্য হয়েছেন তিনি। কিন্তু নীতিগত ভাবে একচুলও নড়েননি। খুচরো ব্যবসায় প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ এখনও মনে করেন, নীতিগত ভাবে এই সিদ্ধান্ত কৃষকদের স্বার্থ রক্ষা করবে। তাই কৌশলগত ভাবে এখনই এই সিদ্ধান্তের পক্ষে সরকার বিজ্ঞপ্তি জারি করছে না বটে। কিন্তু মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তকে খারিজও করে দেওয়া হচ্ছে না।
সংসদে সংখ্যার অভাবে খুচরো ব্যবসায় প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নির সিদ্ধান্ত আপাতত স্থগিত রাখতে বাধ্য হয়েছেন মনমোহন। তাই গত কাল তিনি ছিলেন সব চেয়ে ‘দুঃখী’ মানুষ। কিন্তু দুঃখ পেলেও তিনি ‘পলাতক’ হতে চাননি। তাই আজ সেই হতাশা ঝেড়ে ফেলে আরও এক বার বোঝানোর কাজে নেমেছেন তিনি। এ ক্ষেত্রে যেমন গুরুত্বপূর্ণ শরিক নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে পৌঁছনোর চেষ্টা করা হবে, তেমনই দলের মধ্যে যাঁরা এখনও বিরুদ্ধমত পোষণ করছেন, বোঝানো হবে তাঁদেরও। বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তা চুক্তির বেলায় যেমন সময় নিয়ে মমতাকে বোঝাচ্ছেন সরকারের শীর্ষ নেতৃত্ব, এ ক্ষেত্রেও সেই পথই নিতে চাইছেন তিনি।
শনিবারের পরিস্থিতিকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির এক সদস্য আজ বলেন, “মনে করুন, পাঁচ লক্ষ টাকার একটি র্যাডো ঘড়ি আমার পছন্দ হয়েছে। কিনতে গিয়ে দেখলাম পকেটে আছে ২ লক্ষ টাকা। তার মানে ৩ লক্ষ টাকা কম থাকায় আমার পক্ষে ঘড়িটা কেনা সম্ভব নয়। তার মানে এই নয় যে, ঘড়িটা খারাপ বা ঘড়িটা আমি কিনতে চাইছি না। আমাকে চেষ্টা করতে হবে যাতে, বাকি টাকাও আমি জোগাড় করতে পারি।” অর্থাৎ, কংগ্রেস নেতৃত্ব বোঝাতে চাইছেন, প্রয়োজনীয় সংখ্যা যখন নেই, তখন কী ভাবে এই সিদ্ধান্তকে বাস্তবায়িত করব! কিন্তু তার মানে এই নয় যে, সিদ্ধান্তটি ভুল বা তা থেকে পাকাপাকি ভাবে সরে এসেছি। বাণিজ্যমন্ত্রী আনন্দ শর্মা যেমন স্পষ্ট বলেছেন, “এই সিদ্ধান্ত আমরা প্রত্যাহার করছি না। আমরা নিশ্চিত, এই সিদ্ধান্ত গরিব কৃষকের স্বার্থকে সুরক্ষিত করবে। বিষয়টি না বুঝে অনেকে বিরোধিতা করছেন। তাঁদের বোঝানোটা এই মুহূর্তে সব থেকে বড় কাজ।”
সেই কাজে দলের বিরুদ্ধবাদীদের প্রথমে বোঝাতে চাইছে ‘টিম মনমোহন’। অর্থাৎ, ঘর দিয়েই কাজটা শুরু করতে চাইছেন তাঁরা। সরকারি সূত্রে বলা হচ্ছে, ‘ঘরের লোককে’ বোঝাতে পারলে তখন তারাই ‘বাইরের লোককে’ বোঝানোর কাজে নামবে। তাই প্রবল প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে টিম মনমোহনের মনোভাব হচ্ছে, হাল ছেড়ো না বন্ধু!
কিন্তু ঘরের লোকই হোক বা শরিক, কী বোঝাতে চাইছে টিম মনমোহন? সরকারি সূত্রের খবর, বর্তমান আর্থিক পরিস্থিতি কেমন, সেটাই বোঝানো হবে। ১৯৯১ সালের মতো না হলেও, এখনও যে সংস্কার প্রক্রিয়া চালানো প্রয়োজন, তথ্য-পরিসংখ্যান দিয়ে তা-ই তুলে ধরা হবে। প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের একটি সূত্রের বক্তব্য, “নব্য সংস্কার অত্যন্ত সময়োপযোগী। আর্থিক বৃদ্ধি শতকরা ৭ ভাগের নীচে চলে গিয়েছে। টাকা দুর্বল হয়ে পড়েছে। বিনিয়োগকারীরা
শঙ্কিত। আমলাতন্ত্রের লাল ফিতের ফাঁসে বন্দি ’শয়ে ’শয়ে ফাইল। এমনকী, সোমবার শেয়ার বাজার খুললে সূচক আবার নিম্নমুখী হওয়ারও যথেষ্ট আশঙ্কা। এই অবস্থায় এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া আরও বেশি করে প্রয়োজন।”
এ দিন এইচডিএফসি-র চেয়ারম্যান দীপক পারেখ এবং রাজ্যসভার সাংসদ, হিন্দুস্তান ইউনিলিভারের প্রাক্তন প্রধান অশোক গঙ্গোপাধ্যায়ও এক যৌথ বিবৃতিতে বলেন, “বিরোধীরা এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ আমজনতার স্বার্থ-বিরোধী ভূমিকা নিয়েছেন।” তাঁদের মতে, চাষি, ক্রেতা ও সাধারণ মানুষের কর্তব্য এই মিথ্যে দুর্ভাবনার নাটকের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা। কারণ, এর ফলে বিনিয়োগ ও বাণিজ্য আধুনিকীকরণ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শীতকালীন অধিবেশনের জন্য ৩২টি বিল পড়ে রয়েছে। সেখানে বিরোধীদের সংসদ অচল করে রাখাটা দুর্ভাগ্যজনক।
এই পরিস্থিতিতে মনমোহন এবং কেন্দ্রীয় সরকারের শীর্ষ নেতৃত্ব মনে করছেন, ভারতের মধ্যযুগীয় স্তরে থাকা খুচরো ব্যবসাকে আধুনিক করে বিদেশি লগ্নির জন্য দরজা কিছুটা খুলে দিলে (২৪ নভেম্বরের সিদ্ধান্তেই বলা হয়েছে, ওয়ালর্মাট, টেসকোর মতো সংস্থাগুলিকে এখনও যৌথ অংশীদারিতেই কাজ করতে হবে। শুধু ১০ লক্ষের বেশি জনসংখ্যা বিশিষ্ট শহরগুলিতেই তারা বিক্রয়কেন্দ্র খুলতে পারবে) নতুন প্রযুক্তি পেয়ে আখেরে প্রশিক্ষিত হবেন গরিব কৃষকরাই। দালালরাজ কমবে। তার ফলে খাদ্যের দামও কমবে। এবং মূল্যবৃদ্ধিকে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে।
দলের বিরুদ্ধবাদীদের এই পরিস্থিতিটা বোঝাতে চাইছেন মনমোহন।
প্রধানমন্ত্রী আজ শীর্ষ কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে পুরো পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন। প্রণব মুখোপাধ্যায় তাঁকে জানান, মমতার সঙ্গে কী কথা হয়েছে। ঠিক হয়, বুধবার সংসদ অধিবেশনের আগে মন্ত্রিসভার বৈঠক ডেকে খুচরো ব্যবসায় প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নির সিদ্ধান্তকে আপাতত স্থগিত রাখা হবে। তবে এর পাশাপাশি চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হবে, যাতে বিষয়টি নিয়ে ঐকমত্য গড়ে তোলা সম্ভব হয়। তার পর বুধবার লোকসভায় প্রণববাবু খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নি সংক্রান্ত মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তটি স্থগিত রাখার কথা ঘোষণা করবেন। এই সিদ্ধান্তের মানে হল, মনমোহন সিংহ মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তকে খারিজ করে দিলেন না। কিন্তু এখন এটি বাস্তবায়িত করা হচ্ছে না। সাপ মরলেও লাঠিও যাতে না ভাঙে, সেই কৌশলটাই নিতে উদ্যোগী মনমোহন।
এর সঙ্গে শরিকি বিরোধ মেটাতেও মন দিতে চান প্রধানমন্ত্রী। মমতাকে শনিবার প্রণববাবু সুনির্দিষ্ট আশ্বাস দিয়েছেন। এখন তৃণমূল নেত্রীকে সময় নিয়ে মনমোহন একটি কথা বোঝাতে চান। তা হল, এই বিরোধিতায় পশ্চিমবঙ্গের শিল্পক্ষেত্রে বিনিয়োগের সম্ভাবনা আরও কমবে। এই ঘটনায় শিল্পমহলে যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হয়েছে তারই প্রভাব পড়বে পশ্চিমবঙ্গে। অসন্তুষ্ট শিল্পপতিরা কোন উৎসাহে সে রাজ্যে যাবেন?
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যখন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তখন কিন্তু তিনি মনমোহন এবং কমল নাথের অনুরোধে জার্মানির মেট্রোকে কলকাতায় নিয়ে এসেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে তিনি ওয়ালমার্টের বিষয়টি বিবেচনা করতে রাজি হয়েছিলেন। তবে প্রকাশ কারাট শেষ পর্যন্ত ওয়ালমার্টকে আসতে দিতে রাজি হননি। প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় বলছে, মমতাকেও তথ্য দিয়ে বিষয়টি বোঝানো প্রয়োজন। তখনই বলা হবে, সে দিন কারাট যা করেছিলেন, আজ মমতা সেটাই করলেন!
মনমোহন এবং কংগ্রেসের শীর্ষ নেতারা অনেকেই মনে করছেন, খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নির বিরোধিতা করে মমতা হয়তো বামেদের জায়গাটা দখল করার চেষ্টা করছেন। তাই তিনি নিজের অবস্থানে অনড় থাকার কথা শনিবারও স্পষ্ট করে দিয়েছেন। এবং সে জন্যই মমতাকে নিয়ে সংশয়ও রয়েছে সরকারের মধ্যে। ২২ ডিসেম্বর সংসদের অধিবেশন শেষ হওয়ার পর সরকার যদি আবার বিজ্ঞপ্তি দিতে সচেষ্ট হয়, সে ক্ষেত্রেও মমতা যে আবার সংঘাতে যাবেন না, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। তাই সময় নিয়ে শত চেষ্টা করলেও মনমোহন যে তৃণমূল নেত্রীকে বোঝাতে সফল হবেনই, এমনটাও হলফ করে বলতে পারছেন না ভুক্তভোগীরা।
খুচরো বিতর্কে মমতার সমর্থন খুবই প্রয়োজন কেন্দ্রের। কারণ, বাম-বিজেপি কিন্তু জানিয়ে দিয়েছে, প্রণববাবুর এই ঘোষণা থেকে প্রমাণ হচ্ছে না যে সরকার তাদের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। ‘আপাতত স্থগিত রাখা’ আর পাকাপাকি ভাবে মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তকে খারিজ করে দেওয়া এক নয়। অধিবেশন হয়ে যাওয়ার পর সরকার যে এই প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত আবার বাস্তবায়িত করতে উদ্যোগী হবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়! আর এই দাবিতে তারা আবার মুলতুবি প্রস্তাব আনার দাবি জানাবে।
আনন্দ শর্মা বিজেপির সমালোচনা করে বলেছেন, “বিজেপি ক্ষমতায় থাকাকালীন এই সিদ্ধান্তের পক্ষে ছিল। আজ তারা সরকারকে দুর্বল করবে বলে এর বিরুদ্ধে যাচ্ছে। কিন্তু সরকারকে দুর্বল করতে গিয়ে তারা জাতীয় স্বার্থকে বিসর্জন দিচ্ছে।”
কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্ব এখন মনে করছেন, সিদ্ধান্ত যখন স্থগিত রাখা হচ্ছে, তখন মুলতুবি প্রস্তাবের প্রয়োজন নেই। আর মুলতুবি প্রস্তাব আনতে গেলে তার খসড়া তৈরিতে সরকারের সম্মতির প্রয়োজন। সে ক্ষেত্রে কংগ্রেসও দাবি জানাবে, সরকার যে সিদ্ধান্ত স্থগিত করেছে সে কথাটাও মুলতুবি প্রস্তাবে লিপিবদ্ধ করা হোক।
এখন প্রশ্ন, এই পরিস্থিতিতে ভোটাভুটি হলে মমতা কী করবেন? এই নিয়ে সংশয় রয়েছে বলেই দলের বিরুদ্ধবাদীদের সঙ্গে সঙ্গে তৃণমূল নেত্রীকেও বোঝানোর কাজটা চালিয়ে যেতে চান মনমোহন। |