ধান বিক্রি করতে গিয়ে গুণাগার দিতে হচ্ছে চাষিদের। সরকারি বিজ্ঞাপনকে সামনে রেখে মিল মালিকদের একাংশ চাষিদের প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত ধান বিক্রি করতে বাধ্য করছেন। স্বয়ং খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকও এই ঘটনা স্বীকার করেছেন।
মিলে ধান বিক্রি করতে গেলেই প্রতি কুইন্টালে ১০ থেকে ১৫ কেজি ধান ‘বাট্টা’ (অতিরিক্ত) দিতে হচ্ছে চাষিদের। না দিলে কোনও মিল ধান কিনছে না বলে চাষিদের অভিযোগ। রাইস মিলারস অ্যাসোসিয়েশনের বক্তব্য, চাষিরা যে ধান বিক্রি করতে আসছেন তার ৩৩ শতাংশই চাল তৈরির সময় বাদ যাবে। অর্থাৎ, প্রতি কুইন্টাল ধানে চাল মিলবে ৬৭ কেজি। অথচ কেন্দ্রের নির্দেশিকা অনুযায়ী সরকারকে প্রতি কুইন্টাল ধানে চাল দিতে হবে ৬৮ কেজি। ফলে কুইন্টাল পিছু লোকসান এক কেজি। ওই লোকসান সামাল দিতে চাষিদের কাছ থেকে ‘বাট্টা’ নেওয়া ছাড়া উপায় নেই বলে তাঁদের দাবি। কিন্তু বাড়তি এক কেজি চাল পেতে যেখানে দেড় কেজি ধান হলেই চলে, সেখানে অনেক মিল চাষিদের কাছ থেকে কুইন্টাল পিছু ১০-১৫ কেজি ধান অতিরিক্ত নিচ্ছে কেন, যার দাম চাষিরা পাচ্ছেন না? তার সদুত্তর মেলেনি। অথচ ধান বিক্রি করতে না পারলে সমস্যা বাড়বে। এক বার খরচ করে মিলে ধান এনে আবার তা ফিরিয়ে নিতে হবে। তাই চাষিরা ক্ষতি স্বীকার করেও অতিরিক্ত ধান দিতে বাধ্য হচ্ছেন। খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক নিজেই এ সমস্যার কথা স্বীকার করে বলেন, “বাট্টা নিয়ে অভিযোগ আমিও পেয়েছি। মিল মালিকদের বলে দিয়েছি, চাষির কাছ থেকে ওজনের অতিরিক্ত ধান কেটে নেওয়া চলবে না। প্রয়োজন হলে চালকল মালিকেরা সরকারের সঙ্গে কথা বলুন। সরকার দেখবে কী করা যায়।”
কুইন্টালে এই ৩৩ শতাংশ বাদ দেওয়ার উৎস একটি সরকারি বিজ্ঞাপন। ধান কেনার কাজে বড় শরিক অত্যাবশ্যক পণ্য সরবরাহ নিগমের বিজ্ঞাপন অনুযায়ী, চাল তৈরির সময় ওই ধান থেকে ১৭% আর্দ্রতা, ৪% খারাপ ধান, ৭% মিশ্রিত নিম্ন মানের ধান, ৩%অপুষ্ট ধান এবং ২% জৈব ও অজৈব পদার্থ বাদ পড়বে। এর সঙ্গে বাদ পড়বে ধান ভাঙানো কুঁড়ো-ও। আর সেই বিজ্ঞাপনকে সামনে রেখেই চলছে মিল মালিকদের একাংশের বাট্টার খেলা।
চাষিদের ভোগান্তির এখানেই শেষ নয়। মিল মালিক থেকে সমবায় সংস্থা (যারা এজেন্ট হয়ে ধান কিনবে) পুরোপুরি আসরে না নামায় সরকারি ধান কেনায় এখনও গতি আসছে না। এতে নিগমের কর্তারাও চিন্তিত। ৬ লক্ষ টন ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে নিগম মাঠে নামার কথা বললেও এখনও পর্যন্ত কুড়ি-পঁচিশটি সমবায় আর জনা দশেক মিল মালিক ছাড়া কেউই এজেন্ট হতে এগিয়ে আসেনি! কিন্তু কেন?
নিগম কর্তাদের ব্যাখ্যা, আগে ধান কেনা হত নগদ টাকায়। আর এ বার যত ধান কেনা হবে, তার টাকা হিসেব করে এজেন্টদের আগাম টাকা জমা দিতে হচ্ছে নিগমকে। সেই টাকা নিগমের ব্যাঙ্কের খাতায় জমা পড়ার পর অফিসাররা চাষিদের ধানের দাম অ্যাকাউন্ট-পেয়ি চেকে মেটাতে যাচ্ছেন। নতুন ব্যবস্থায় পুরো প্রক্রিয়া মিটতে কম করেও দশ দিন লাগছে। এই ভাবে হাজার টন ধানের জন্য কেউ ১ কোটি ৮০ লক্ষ টাকা জমা দিলে ওই দশ দিনে ৫০ হাজার টাকা সুদ খোয়াতে হচ্ছে! তাই ঝুঁকি নেওয়ার আগে তাঁরা ভাবছেন। তাই এজেন্ট হওয়ার জন্য হাজার টাকার শ’দেড়েক ফর্ম বিক্রি হলেও দশ জনের বেশি টাকা জমা দেননি। নিগমের এক অফিসারের বক্তব্য, “চেকের বদলে নগদ টাকায় ধান কেনার পুরনো ব্যবস্থায় ফেরার জন্য কেন্দ্রের কাছে চিঠি লেখার কথাও ভাবা হচ্ছে। তা ছাড়া, ৫-১০ বিঘার প্রান্তিক চাষিরাও ধান বিক্রির জন্য ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের ঝামেলা এড়াতে ফড়েদের পুরনো চক্করেই ফিরে যাচ্ছেন। সেটাও কাম্য নয়।” |