বিদ্যাজাহির তর্কালঙ্কার মহাশয় বললেন, তোমাদের তো পুঁথিজ্ঞান নেই, থাকলে তোমরা এই পুঁথি খুলেই দেখে নিতে পারতে। পুঁথিতে এমনটাই লেখা আছে নদী পেরিয়ে এই বনমালীপুরে এক বারো হাত লম্বা একটা কেঁদো বাঘ আসবে। পুঁথিজ্ঞান থাকলে তোমরা এই শেষ সময়ে আমার কাছে নিদান চাইতে আসতে না। লাঠি-বল্লম নিয়ে মাদল বাজাতে বাজাতে বাঘটাকে তাড়িয়েই ছাড়তে।
গ্রামের মোড়ল সত্যচরণ সাধুখাঁ বললেন, বনমালীপুরে তো বাঘ আসেনি ঠাকুর মশাই!
তর্কালঙ্কার বললেন, মানে?
মোড়ল বললেন, মানে বনমালীপুরে বাঘ আসেনি।
তর্কালঙ্কার পৈতে বের করে বুড়ো আঙুলে জড়িয়ে বললেন, জয় জগদম্বে! জয় জগদম্বে! মা, মাগো, তোমার কী অপার করুণা মাগো। আমি জানতাম তুমি রক্ষে করে দেবে।
মোড়ল বললেন, তা শেষ রক্ষা আর হল কোথায়? বাঘটা যে পাক খাচ্ছে!
পাক? কোথায়? তর্কালঙ্কার লাফিয়ে উঠলেন। |
মোড়ল বললেন, লাফাবেন না। লাফাবেন না। রোগা ফিঙের মতো একটা লোক। মুখে চার-পাঁচ দিনের না-কামানো দাড়ি। বুকের পাঁজর এক মাইল দূর থেকেও স্পষ্ট দেখা যায়। মাথার নীচে গামছা পাট করে দিয়েছে। আদুল গা। পরনে লুঙ্গি। তাও তেলচিটে। লোকটা...
তর্কালঙ্কার ভরসা পেয়ে উবু হয়ে বসে বললেন, লোকটা নিশ্চয় বাঘ তাড়াবার মন্ত্র বেচতে এসেছে! আমি তো জানতাম লোকটা আসবেই। তোমাদের তো পুঁথিজ্ঞান নেই, থাকলে তোমরা নিজেরাই পুঁথি খুলে দেখে নিতে। এ রকম একটা লোক যে সবাইকে ধাপ্পা দিতে আসবে, পুঁথিতে তাও লেখা আছে। কিন্তু জেনে রাখো তোমরা, বনমালীপুরে বিদ্যাজাহির তর্কালঙ্কার থাকতে কেউ তোমাদের ধাপ্পা দিতে পারবে না।
রাখুন তো মশাই আপনার পুঁথিজ্ঞান, ধমকে উঠে মোড়ল মশাই বললেন, আমি বলছি পাকের কথা আর আপনি চলে গেলেন ধাপ্পায়?
তর্কালঙ্কার বুঝলেন ভুল হয়ে গিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি নিজেকে শুধরে নিয়ে বললেন, রাগ করছ কেন? রাগ করছ কেন? তুমি বলছ যখন, আমি ধাপ্পা থেকে না-হয় পাকে ফিরে যাচ্ছি। কিন্তু পুঁথিতে লেখা আছে আর তুমিই তো বলছিলে, ‘রোগা ফিঙের মতো একটা লোক। মুখে চার-পাঁচ দিনের না কামানো দাড়ি...।’
মোড়ল বললেন, আমি তো ঠিকই বলছিলাম, আপনিই তো মেলা ফ্যাচ ফ্যাচ করে সব গুলিয়ে খেলেন। আমি বলতে যাচ্ছিলাম, রোগা ফিঙের মতো একটা লোক নদীর ওপারে যেখানে ঝোপের ছায়া পড়ে সেখানে শুয়ে আছে আর একটা বারো হাত লম্বা বাঘ পাক দিচ্ছে তাকে। মানুষটাকে বাঁচাতে হবে। আপনার ঘরে অনেক দিন আগে জং ধরা একটা বল্লম দেখেছিলাম। সেটা কি আছে?
তর্কালঙ্কার মাথা দোলালেন, আছে বোধ হয়। আমি তো এখন ঘর পরিষ্কার-টরিষ্কার করি না। আমার মেয়ে করে। ঘর পরিষ্কার করতে গিয়ে সে বোধ হয় বল্লমটা কোথাও তুলেটুলে রেখেছে। তোমরা বরং সাঁঝবেলায় এসো। মেয়ে কলেজ থেকে ফিরলে ওকে বলব জং ধরা বল্লমটা বের করে দিতে।
মথুরানাথ মল্লিক বিরক্ত হয়ে বলল, আমি আগেই বলেছিলাম তর্কালঙ্কার ভরসাযোগ্য নয়। বাঘ কি জং ধরা বল্লমের জন্য সাঁঝবেলা পর্যন্ত অপেক্ষা করবে? হয়তো এখনই রোগা ফিঙের মতো লোকটাকে অর্ধেক চিবিয়ে খেয়েই ফেলেছে। গ্রামের আর সবাই বলল, বাঘের তো আর পুঁথিজ্ঞান নেই। আমাদের এখানে আসাটাই ভুল হয়েছে। চলো, চলো। আমরা বরং বাঘটাকে না মেরে তাড়াবার কথা ভাবি। ঢাক-ঢোল আর এত মানুষের চিৎকারে বাঘটা দেখো কালা হওয়ার ভয়ে নিশ্চয়ই পালিয়ে যাবে।
গ্রামের লোকেরা দল বেঁধে চলল নদীর দিকে।
গল্পটা এ বার তবে প্রথম থেকেই বলি। কিছু ক্ষণ আগে বনমালীপুরের কচিকাঁচারা নদীর এপারে ক্রিকেট খেলছিল। স্কুলমাস্টার নরহরি বাঁড়ুজ্জ্যের নাতি নবুর হাঁকানো ছক্কায় বলটা গিয়ে পড়েছিল নদীর ওপারের ঝোপের আড়ালে। নদী পেরিয়ে বল আনতে গিয়ে কচিকাঁচারাই প্রথম দেখে, ঝোপের ছায়ায় শুয়ে আছে রোগা ফিঙের মতো একটা লোক। খালি গায়ে। গামছা মাথার নীচে পাট করে রেখে। আর লোকটাকে মাঝখানে রেখে বারো হাত লম্বা একটা কেঁদো বাঘ সমানে পাক দিয়ে যাচ্ছে।
ভয়ে কচিকাঁচারা গ্রামে পালিয়ে এসে সবাইকে খবরটা দেয়। খবর পেয়েই গ্রামের মানুষেরা ঠিক করে, যে করেই হোক মানুষটাকে বাঁচাতে হবে। আহারে বেচারা! গত রাতে হয়তো খুব পরিশ্রম করেছে। বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগটুকুও পায় নে। সে জন্য একটু ছায়া দেখেই গা এলিয়ে দিয়েছে। বেচারা জানতেও পারছে না, তাকে খাবে বলে বারো হাত লম্বা একটা কেঁদো বাঘ সমানে পাক দিচ্ছে তার চার দিকে।
গ্রামবাসীরা ঢাক-ঢোল পেটাতে পেটাতে চলল নদীর ওপারে। কিন্তু এ কী! ঢাক-ঢোল আর মানুষের চিৎকার শুনে বাঘটা যে এ দিকেই ছুটে আসছে দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে।
মোড়ল মশাই বললেন, ভাইসব, শক্ত করে ধরো লাঠি। জং ধরা বল্লম পেলাম না বলে আমাদের মনোবল ভাঙলে চলবে না। লোকটাকে বাঁচাতেই হবে। আর লোকটাও হয়েছে তেমনি। বাঘটা এত দূরে চলে এসেছে, কোথায় এই সুযোগে ঘুম থেকে উঠে কেটে পড়বে...
মোড়লের কথা শেষ হওয়ার আগেই লোকটার ঘুম ভেঙে গেল। মাথার তলা থেকে গামছা নিয়ে গা-হাত-পা ঝাড়তে ঝাড়তে উঠে বসল লোকটা। নিরীহ গোবেচারা চোখে চার পাশটা দেখতে দেখতে বারো হাত লম্বা কেঁদো বাঘ দেখেই চিল্লে উঠল লোকটা হাসি! হাসি! তোর সাহস তো মন্দ নয় রে! তোকে বলেছিলাম না দূরে কোথাও যাবি না।
গ্রামবাসীদের দাঁত-মুখ খিঁচানো ছেড়ে বারো হাত লম্বা কেঁদো বাঘ লেজ নাড়তে নাড়তে এগিয়ে গেল লোকটার কাছে। রোগা ফিঙের মতো লোকটা বাঘের গলায় গামছা বেঁধে বলল, বড় দুষ্টু হয়েছিস তুই। যতই কাকুতিমিনতি করিস তোর গলা থেকে আমি আর গামছা খুলছি না। তার পর গামছার খুঁট ধরে টানতে টানতে বাঘটাকে নিয়ে চলল জঙ্গলের দিকে।
গ্রামবাসীরা অবাক! লোকটা কে? আস্ত একটা বাঘের গলা গামছায় বেঁধে হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে!
মোড়ল মশাই জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কে মশাই? এমন ভাবে বাঘ বেঁধে নিয়ে যাচ্ছেন কেন?
রোগা ফিঙের মতো লোকটা বিরক্ত হয়ে বলল, আমি হলাম বাঘের মালিক। আমার বাঘকে আমি ধরে নিয়ে যাই আর বেঁধে নিয়ে যাই, তাতে আপনার কী? |