|
|
|
|
দূরদৃষ্টির বয়স সবে ৪০০ |
‘টেলি’ মানে দূর, সব্বাই জানি। আর ‘স্কোপেইন’ হল দেখা।
দুইয়ে মিলে টেলিস্কোপ। নামটা এসেছে ১৬১১’য়।
যন্ত্রটি আরও কিছু আগে। পথিক গুহ |
উন্মুক্ত হল বিশাল এবং দারুণ বিস্ময়কর দৃশ্যাবলি। সকলের, বিশেষত দার্শনিক ও জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের চোখের সামনে উদ্ভাসিত হল সেই সব বস্তু, যা দেখেছেন গালিলেয়ো গালিলেই, ফ্লোরেন্স শহরের বিশিষ্ট নাগরিক, পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতজ্ঞ, যিনি নিজের বানানো আতসকাচে সম্প্রতি দেখেছেন চাঁদ, অসংখ্য তারা, মিল্কি ওয়ে, নীহারিকা, বিশেষত বৃহস্পতি নক্ষত্র প্রদক্ষিণকারী চারটি গ্রহ, যাদের আবর্তনকাল ও বেগ আলাদা, যাদের খবর আজ পর্যন্ত কেউ জানে না, যাদের নাম লেখক দিয়েছেন মেদিসীয় নক্ষত্র। ওফ্, ইয়া লম্বা এক বাক্য বটে! বাক্য নয়, ওটি আসলে একটি বইয়ের সাবটাইটল। বইখানির প্রকাশ ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে। সে যুগে বইয়ের সাবটাইটল লম্বাই হত। তবু, সে তুলনাতেও যেন বেশি দীর্ঘ এটি। হবেই, কারণ ওটি শুধু সাবটাইটল নয়, বইটির প্রোমো-ও। বিজ্ঞাপনের উদ্দেশ্য সফল। ছেপে বেরনোমাত্র বইখানি বেস্টসেলার। বইয়ের নাম ‘সাইডেরাস নানসিয়াস’। অনুবাদ করলে যা দাঁড়ায় ‘নক্ষত্রের বার্তা’ বা ‘নক্ষত্রের দূত’। লেখক? অবশ্যই গালিলেয়ো গালিলেই।
‘সাইডেরাস নানসিয়াস’ আসলে যতটা না বই, তার চেয়ে বেশি পরীক্ষার রিপোর্ট। নতুন আবিষ্কৃত যন্ত্র দূরবিনে রাতের আকাশ খুঁটিয়ে দেখে যা যা জেনেছিলেন গালিলেয়ো, তার দীর্ঘ বর্ণনা ওই বইয়ের পাতায়। দূরবিনে কবে আকাশ দেখা শুরু করেছিলেন তিনি? উত্তর খুঁজতে বসে বিজ্ঞানের ইতিহাসবিদরা একমত নন। বন্ধুদের কাছে দূরবিন যন্ত্রের আবিষ্কারের খবর পেয়ে নিজেও তা বানান গালিলেয়ো। সেটা অবশ্যই অন্যদের বানানো যন্ত্রের চেয়ে অনেক উন্নত। মানে, তা দূরের বস্তুকে অনেক বেশি বড় এবং সে কারণে অনেক বেশি কাছের বানিয়ে ফেলতে পারে। এ রকম যন্ত্র গালিলেয়ো বানিয়ে ফেলেছিলেন ১৬০৯ খ্রিস্টাব্দের জুন-জুলাই মাসে। আর রাতের আকাশ দেখা? অনেকের মতে তা ওই বছরের ২ অক্টোবর তারিখের ঘটনা। আবার কেউ কেউ মনে করেন, ১৬০৯ খ্রিস্টাব্দে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে কোনও এক রাতে দূরবিনে চোখ রেখে প্রথম আকাশ দেখেছিলেন গালিলেয়ো। এ দু’রকম অনুমানের একটিও মানতে কষ্ট হয়। কারণ, জুলাই মাসে যদি দূরবিন বানিয়ে ফেলেন তিনি, তা হলে অক্টোবর বা ডিসেম্বরে প্রথম আকাশ দেখবেন কেন? আসলে ‘সাইডেরাস নানসিয়াস’-এ রাতের আকাশের যে বর্ণনা তিনি দিয়েছেন, তা থেকে জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের ও রকম অনুমান।
যে রাতেই প্রথম আকাশ দেখা শুরু করেন গালিলেয়ো, তাঁর আবিষ্কারগুলি অভিনব।
কী রকম?
(১) চাঁদের বহুতল মোটেই মসৃণ নয়, সেখানে যত্রতত্র পাহাড় কিংবা গহ্বর;
(২) খালি চোখে যত দেখা যায়, আকাশে নক্ষত্র তার চেয়ে অনেক বেশি;
(৩) মিল্কি ওয়ে, মানে ছায়াপথ আসলে লক্ষ কোটি তারার সংসার;
(৪) বৃহস্পতি গ্রহ নিজেই যেন এক পরিবার, তাকে প্রদক্ষিণ করছে চারটি উপগ্রহ;
(৫) সূর্যের গায়ে অনেক কলঙ্ক;
(৬) অমাবস্যা থেকে পূর্ণিমার মাঝে যেমন নানা কলা, শুক্র গ্রহও পৃথিবী থেকে ও রকম নানা আকৃতিতে ধরা পড়ে।
১৬১০ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে প্রকাশিত ‘সাইডেরাস নানসিয়াস’ সত্যিই এক বেস্টসেলার। বেরনোমাত্র বিক্রি হল ৫০০ কপি। কে কবে পড়ে ফেলবে বইখানি, তার প্রতিযোগিতা। হবেই, আকাশ দেখে যা যা বললেন গালিলেয়ো, তা যে চাঞ্চল্যকর। অ্যারিস্টটল বলেছেন, চাঁদ হল সুচারু গোলক। তার উপরিতল মসৃণ। কই, তা তো সত্যি নয়। ওই বইতে গালিলেয়ো লিখলেন, ‘চাঁদের চাদরখানি মোটেই মসৃণ নয়। চাঁদ একেবারে পৃথিবীর মতো। তার উপরিতলে এখানকার
মতোই পাহাড়, উপত্যকা কিংবা খাদ।’
বৃহস্পতি গ্রহের ব্যাপারটাও বেশ গোলমেলে। যাঁরা নিকোলাস কোপারনিকাস-বর্ণিত সূর্যকেন্দ্রিক বিশ্বের ধারণা মানতে চাইছেন না, তাঁরা বড় যুক্তি খাড়া করছেন এ কথা বলে যে, চাঁদের ব্যাপারটা তো ব্যতিক্রম। আর কোনও গ্রহের চার পাশে তো ঘুরছে না এ রকম একটি বস্তু। গালিলেয়ো সে যুক্তিখণ্ডন করে লিখলেন, ‘এখন আমাদের চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি, চারটে নক্ষত্র [বৃহস্পতির উপগ্রহগুলিকে ওই নামেই অভিহিত করছেন তিনি] ঘুরছে ওই গ্রহটির চার পাশে। ঠিক যে ভাবে চাঁদ ঘুরছে পৃথিবীর চার দিকে।’
শুক্র গ্রহ? তার নানা রকম কলার ব্যাখ্যা কী? গালিলেয়ো লিখলেন, শুধু কলা নয়, পৃথিবী থেকে দেখলে ওই গ্রহের সাইজেরও পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। পৃথিবীর সাপেক্ষে সূর্য আর শুক্রের অবস্থান মনে রাখলে এর একমাত্র ব্যাখ্যা: ওই গ্রহটি ঘুরছে সূর্যের চার পাশে, পৃথিবীকে ঘিরে নয়। তাঁর মন্তব্য, ‘চূড়ান্ত প্রয়োজনীয় যে সিদ্ধান্তে আমরা পৌঁছচ্ছি, তা হল, সে যুগে পিথাগোরাসের অনুগামীদের, এবং এখন কোপারনিকাসের, ধারণা ঠিক। অন্য গ্রহগুলির মতোই শুক্রও ঘুরছে সূর্যের চার পাশে।’
ভেনিস শহরে ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত হেনরি ওটন ইংল্যান্ডের রাজাকে ডাকযোগে পাঠালেন এক কপি ‘সাইডেরাস নানসিয়াস’। বইখানি, রাষ্ট্রদূতের মতে, ‘স্ট্রেঞ্জেস্ট পিস অব নিউজ’।
স্কটল্যান্ডের কবি টমাস সেগেট লিখলেন,
‘কলম্বাস গেভ ম্যান ল্যান্ডস টু কনকার বাই ব্লাডশেড
গালিলেয়ো নিউ ওয়ার্ল্ডস হার্মফুল টু নান
হুইচ ইজ বেটার?’
হ্যাঁ, গালিলেয়োর তুলনা করা হল কলম্বাসের সঙ্গে। খ্যাতির পাশাপাশি তাঁর জীবনে এল বাড়তি প্রতিপত্তি সামাজিক এবং আর্থিক। অবশ্য, এর মূলে তাঁর চতুর পদক্ষেপ। গবেষণা, বলা বাহুল্য, প্রায়শই স্পনসর-মুখাপেক্ষী। প্রাক্তন ছাত্র সদ্য গ্র্যান্ড ডিউক হয়েছেন টাসকানি-র। ‘সাইডেরাস নানসিয়াস’ তাঁকে উৎসর্গ করেছেন গালিলেয়ো। বৃহস্পতির চার উপগ্রহ চিহ্নিত করেছেন ডিউক পরিবারের নামে। ফলে তিনি এ বার ওই পরিবারের চিফ ম্যাথমেটিশিয়ান। বেতন বছরে ১০০০ ফ্লোরিন!
খ্যাতিমান বা অর্থবান যতই হোন গালিলেয়ো, বিতর্ক কিন্তু শুরু হল দূরবিনের আবিষ্কারগুলি ঘিরে। পৃথিবীর যদি আহ্নিক এবং বার্ষিক গতি থাকবে, তা হলে মানুষ ছিটকে বেরিয়ে যাচ্ছে না কেন ভূ-পৃষ্ঠ থেকে? বাতাসের ঝড় সব সময় বইছে না কেন সব জায়গায়? গাছের ফল মাটিতে পড়ার সময় ঠিক নীচে না পড়ে একটু দূরে পড়ছে না কেন? গালিলেয়োর সমালোচকেরা বললেন, দূরবিনে কোনও বস্তুকে বড় এবং কাছের মনে হয়। অর্থাৎ, যা নয়, তা-ই মনে হয়। তা হলে তো ত্রুটি মানুষের নয়, যন্ত্রের। মনুষের চোখ যা দেখে, তা বাস্তব। যন্ত্র যা দেখায়, তা অলীক। যন্ত্রের মারফত শনাক্ত বস্তুর অস্তিত্ব মানা হবে কেন? আজ শুনতে হাস্যকর মনে হলেও, ওই সমালোচনা কিন্তু অযৌক্তিক নয়। ওই সমালোচনার যোগ্য জবাব দেওয়ার ক্ষমতা গালিলেয়োর ছিল না। কারণ, দূরবিনের কাজের তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা তখনও মেলেনি। দূরবিন যে অলীক দৃশ্য উপহার দিচ্ছে না, তা প্রমাণ করতে সেই তাত্ত্বিক জ্ঞান হাতে থাকা দরকার।
পদার্থবিদ্যার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে ওই তাত্ত্বিক জ্ঞান। বদলে গেছে দূরবিন। মহাশূন্যের বিবিধ বস্তু থেকে যে সব সংকেত নির্গত হয়, তার সবটা যে মানুষের চোখ শনাক্ত করতে পারে না, বহু কাল আগে তা বোঝা গেছে। ফলে এসেছে রেডিয়ো টেলিস্কোপ। দৃশ্যমান আলোর বদলে বেতার তরঙ্গ শনাক্তকারী যন্ত্র। তেমন দূরবিন আবার শুধু ভূপৃষ্ঠে রাখাও সমীচীন নয়। পৃথিবীকে ঘিরে যে আয়নোস্ফিয়ার, তার ফলে ও রকম কিছু তরঙ্গ আবার নির্বিঘ্নে পৃথিবীতে সংকেত পৌঁছে দিতে পারে না। তাই এখন মহাশূন্যে পাঠানো হচ্ছে দূরবিন। এ প্রসঙ্গে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘নাসা’-র পাঠানো চারটে বড় দূরবিনের কথা বলতে হয়। হাবল স্পেস টেলিস্কোপ (মহাশূন্যে পাঠানো হয়েছিল ১৯৯০ সালে), কম্পটন গামা-রে অবজারভেটরি (১৯৯১), চন্দ্র এক্স-রে অবজারভেটরি (১৯৯৯) এবং স্পিংজার স্পেস টেলিস্কোপ (২০০৩)। এদের এক-একটার ক্ষমতা বিশেষ বিশেষ বেতার তরঙ্গ শনাক্ত করা। আর সবচেয়ে বড় কথা, এদের পিছনে ব্যয়। মহাশূন্যে কাজ করতে করতে হাবল টেলিস্কোপে যান্ত্রিক ত্রুটি ধরা পড়ে। তা শোধরানোর জন্য বিশেষ অভিযানের আয়োজন করতে হয় ১৯৯৩ সালে। বানানো, মহাশূন্যে পাঠানো, মেরামতি এবং তার পর কাজ চালানো এ সব মিলে ওই দূরবিনের পিছনে নাসা-র খরচ হয়েছে ৬০০ কোটি ডলার!
পুনশ্চ: ‘সাইডেরাস নানসিয়াস’-এ গালিলেয়ো দূরবিনকে বলেছিলেন ‘পারস্পিসিলাম’। লাতিন ভাষায় যার অর্থ ‘সন্ধানী কাচ’। গ্রিক গণিতজ্ঞ জিয়োভানি দেমিসিয়ানি ১৬১১ খ্রিস্টাব্দে চালু করেন টেলিস্কোপ শব্দটা। টেলি (দূর) আর স্কোপেইন (দেখা) মিলিয়ে। ‘টেলিস্কোপ’ নামটির এ বার ৪০০ বর্ষ পূর্তি। |
|
|
|
|
|