মাটির মানুষ রঙ ঢাকে না দারিদ্র,
তবুও আঁকা হয় পট

পুরুলিয়ার গড়ধ্রুবেশ্বর পঞ্চায়েতের তুড়কা গ্রামের পটুয়াটোলার সর্বাঙ্গে দারিদ্র্যের ছাপ। চল্লিশ ঘর বসতি পটুয়াদের। এই টোলায় পিচের রাস্তা এসেছে। তবে গ্রামবাসীদের বিপিএল কার্ড অজানা। ইন্দিরা আবাসন দূরে। চাষজমি, তাও যৎসামান্য। গ্রামীণ শিল্পী-ভাতা এঁদের অজানা। এমনই তথ্য দিলেন শিল্পীরা। সেই সঙ্গে সমস্বরে বেরিয়ে এল দীর্ঘদিনের ক্ষোভ, “আপনারা সরকারি টাকায় আমাদের ভিডিও ক্যামেরা করে টাকা পিটবেন। কাগজে ছবি ছাপবেন, উয়াতে আমাদের কী উপকার?”
বাস্তবিক। এর কোনও উত্তর জানা নেই। দারিদ্রে, ক্ষোভে একজন শিল্পী সামান্য পারিশ্রমিক নিয়ে পট দেখাতে, কথা বলতে রাজি হলেন। মাত্র দুজন শিল্পীর কাজ (পট) দেখা ও কথা বলার সুযোগ হল। প্রথম জন ষাটোর্ধ্ব। অপুষ্টির চাপে-ছাপে বয়স আরও বেশি দেখায়। মাথায় জটা মনভুলা চিত্রকরের পট দেখলে মন ভুলে যায় সবকিছু। কৈশোরে ভাল পট লিখতেন বলেই দাদুর দেওয়া সাধের নামের স্মৃতি।
নিজস্ব চিত্র।
এই পটুয়ারা সর্বঅর্থেই প্রান্তবাসী। সামাজিক পদবি বাউড়ি। বাবা, প্রয়াত লবঘন (নবঘন) পটুয়া। তাঁরই কাছে পট-লেখা শেখা। পটের পরমায়ু হেসে-খেলে দু’এক পুরুষ। তবে পট ফেটে ছিঁড়ে গেলে মেরামতির দরকার। একেবারে অচল হলে বিশেষ দিনে, স্নানের পরে ‘পট-বিসর্জন’। আবার নতুন পট আঁকা। নতুন গান বাঁধা। অনেক সময় বিষয়বস্তু এক ঘেয়ে হলে, শিল্পী তৈরি করেন নতুন পট। বদলে যায় কাহিনি। পট বিসর্জনের আগে কপিও করে নেন অনেকে। পটের সুলুক সন্ধানের খবর জানা গেল এঁদের কাছে।
পটের যত ভাগ আছে, তার মধ্যে এখানে যেটা পাওয়া গেল তা স্ক্রোল বা গোটানো, জড়ানো পট। দুই প্রান্তে দুটি ডাং বা ছোট লাঠি। মাঝে লম্বা কাপড়। ওপরে কাগজ সাঁটা। তার ওপরে পর পর আঁকা ছবি। যা মূল গল্পকে বেঁধে রাখে। পটুয়া পট খুলে কাহিনি বলে যান। পটও একটু একটু করে খোলে, ডান দিক থেকে বামে। বাঁ হাত দিয়ে পট একটু একটু গুটিয়ে নিতে হয়। আবার উল্টোটাও হতে পারে। পটে ব্যবহার হয় দেশজ রং। তবে এখন সময়ের দাবিতে এখানেও এসে গিয়েছে কেনা রঙের ছোঁয়া।
কিন্তু এত সুন্দর এক শিল্পের ভবিষ্যৎ?
প্রশ্নটা আরও ভাবিয়ে তোলে যখন শোনা যায় এই কাজে নতুন প্রজন্মের এগিয়ে আসা প্রায় বন্ধ। শোনা যাক মনভুলা পটুয়ার কথায়। “যুয়ান ছেলেরা আসছে নাই। পেট কাঁদিয়ে কত দিন ‘ভিখ’ মাঙবে। নতুন গান বাঁধার মন নাই। ভিখ মাঙতে শরম। বাপ-কাকাদের কষ্ট দেখে উয়ারা আসবে কেনে পটে? সব ঘুচাই গেল। আপনারা সব ভদ্দোর লোকরা আসি পেঁদা (মিথ্যা) কথা বলেন। সরকার সাহায্য দিবে।” শিল্পীর দীর্ঘ বঞ্চনার ইতিহাস ফের উঠে আসে। গৃহস্থের বাড়ি বাড়ি পট দেখিয়ে জীবিকাশ্রয়। এক সময় বৈষ্ণব সমাজের মতো ‘মাধুকরী’ বৃত্তিই ছিল। যা সমাজ অনুমোদিত। শ্রদ্ধারও। এখন তাতেও ভাটার টান।
যমপটের দেখা এখন এখানে খুব কম মেলে। কারণ ‘যম’ নিত্য আসেন না। পড়শি বা দূরের গ্রামের কেউ মারা গেলে, কোনও পটুয়া তাকে স্বপ্নে দেখেন। অথবা ঘরের উঠোনে, থালায় রাখা হলুদ জলে তার মুখ দেখতে পান। তখন পটুয়া তাঁর (মৃত) অবয়ব আঁকেন। কাজ শেষ হলে মৃতের বাড়িতে যান। এবং সেখানে মৃতের আত্মার শান্তি কামনায় সকলের সামনে পটে ‘চক্ষুদান’ করে আত্মার ‘মুক্তি’ ঘটান। পারিশ্রমিক হিসাবে পটুয়া পেতেন ‘সিদে’ (চাল-ডাল-সবজি-অর্থ)। এই ছিল সামাজিক বিধান। সেই সমাজ-সূত্র বর্তমানে ছিন্ন। শিতিকণ্ঠ, শঙ্কর, সন্তোষ চিত্রকরের গলায় শোনা গেল পটের এমনই ইতিহাস। মনভুলার পরের প্রজন্মের পটুয়া এঁরা। সকলেই প্রায় পঞ্চাশের কোঠায়।
কিন্তু তার পর?



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.