|
|
|
|
|
|
প্রতি পক্ষ |
জনস্থানে শিল্প |
শিল্পকে মুষ্টিমেয় কিছু চর্চাকারী মানুষের গণ্ডি ছাড়িয়ে জনতার দরবারে নিয়ে আসার
একটি আয়োজন লাগে। সিমা-য় সেই আয়োজনের সাক্ষী থাকলেন শোভন তরফদার |
অধুনা প্রয়াত পরিতোষ সেন তখন বয়সে তরুণ। শিল্পকলার উচ্চতর পাঠ নিতে গিয়েছেন প্যারিস। সেখানে শিক্ষাপর্বের পাশাপাশি ল্যুভর, নোতরদাম বা মমার্ত যেমন দেখা প্রয়োজন, তেমনই কিছু দিন অন্তর সেলুন-এও না গেলেই নয়। সালোঁ এবং সেলুন উভয়ই জীবনধারণের পক্ষে জরুরি। সেই চাহিদা মেনেই সেলুন-গমন। ঢুকে দেখলেন, সেখানে আধুনিক ফরাসি শিল্পীদের অজস্র প্রিন্ট ঝুলছে। নরসুন্দর যিনি, তিনি চুলের ছাঁটের খেয়াল রাখছেন তো বটেই, পাশাপাশি খদ্দেরটি শিল্পী জেনে শিল্পকলার হালচাল নিয়েও রীতিমতো আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন, ক্লদ মোনে বা পাবলো পিকাসো, কারও বিষয়েই তাঁর আগ্রহ কম নয়। তরুণ পরিতোষ ঠিক কী পরিমাণ বিস্মিত হয়েছিলেন, সে কথা নিজেই পরে লিখেছেন বিভিন্ন রচনায়। বিস্ময়ের কারণ এটাই যে শিল্পকলার বোধ জনমনে ঠিক কতখানি প্রবেশ করলে, এই জিনিস সম্ভব!
গল্পটি উঠে এল টুকরো কথার ফাঁকে। এমন একটি জায়গায় যেখানে আমজনতা এসে দাঁড়িয়েছেন শিল্পের দুয়ারে। এই যোগাযোগটি বিস্ময়কর, কিন্তু সত্য। সৌজন্য, সিমা গ্যালারির বাৎসরিক আর্ট মেলা! গোড়ায় স্টুডিও ২১-এ শুরু হয়েছিল বটে, ঈষৎ ছোট পরিসরে, কিন্তু জনতার আগ্রহই তাকে নিয়ে এল সিমা গ্যালারির প্রশস্ত অঙ্গনে। গ্যালারির চার দেওয়ালে তো বটেই, এমনকী নীচে প্রবেশপথের চত্বরে রীতিমতো সামিয়ানা খাটিয়ে ছবি, ভাস্কর্য, আড্ডা, খাওয়াদাওয়া মিলিয়ে সেই উৎসব এখন আক্ষরিকই মেলা! গত সপ্তাহে, অর্থাৎ নভেম্বরের ২৫ থেকে ২৭, তিনটি দিন সকাল এগারোটা থেকে রাত্রি আটটা পর্যন্ত চলেছিল এই বিচিত্র শিল্পায়ন! এ বার নিয়ে পর পর চার বছর।
‘প্রথম দু’দিন সকালের দিকটা দেখেছি, তুলনায় বয়স্কেরা বেশি আসছেন। আর একটু বিকেল হলে, বা সন্ধের দিকে কমবয়সীদের ভিড়টা বেশি’, জানাচ্ছেন সিমা গ্যালারির চিফ কো-অর্ডিনেটর প্রতীতি বসু সরকার, ‘রবিবারে অবশ্য গোটা সময়টা জুড়েই নানা বয়সীদের ভিড় ছিল।’
ভিড় তো হল, কিন্তু সেই ভিড়ের চরিত্রটি কী রকম?
‘অনেকেই ফার্স্ট-টাইমার। এই প্রথম কোনও শিল্পকাজ কিনছেন হয়তো, ফলে নানা রকম প্রশ্ন, কাজটাকে কী ভাবে বাঁধাব, কোথায় বাঁধাব? আরও একটু সচেতন যাঁরা, তাঁরা প্রশ্ন করছেন, এই যে কাজটা কিনলাম, কী রকম দেওয়ালে রাখলে এটা ঠিকঠাক খুলবে?’
অর্থাৎ, নেহাৎই একটা কাজ কিনলাম, খানিকটা ঠাট বজায় রাখার জন্য, তা নয়। শিল্পের প্রতি একটা টান গভীরে কোথাও কাজ করছে হয়তো! |
|
ছবি: দেবীপ্রসাদ সিংহ |
সিমা গ্যালারি জানাচ্ছে, শিল্পী চয়নের ভিতরেও একটি বিশেষ প্রবণতা স্পষ্ট। যাঁরা তুলনায় বয়স্ক ক্রেতা, তাঁরা যাচ্ছেন প্রবীণ ‘মাস্টার’-দের কাজের দিকে। যাঁরা নবীনতর, তাঁরা ঝুঁকছেন নবীন শিল্পীদের প্রতি। সন্দেহ নেই, কাজের দাম তার একটা কারণ। কিন্তু, সেটাই একমাত্র কারণ বলে ভেবে নিলে মস্ত ভুল হবে। কারণ, নবীনতর শিল্পীদের কাজের চাল-চরিত্রের সঙ্গে অল্প বয়স্কেরা নিজেদের ভাব-ভাবনাকে মেলাতে পারছেন বেশি। সমকালীন যে ধরনের দৃশ্যকে ভেঙে নতুন শিল্পীরা নিজেদের শিল্পকলার বিষয় নির্মাণ করছেন, সেই সব দৃশ্য তাঁদের অনেকটাই চেনা। তাই, চেনা দুঃখ চেনা সুখের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করাটাও তুলনায় সহজ।
এই প্রবণতা থেকে একটা খুব জরুরি কথা উঠে আসে। নবীনরা নিজেদের জীবনটাকেও শিল্পের দর্পণে দেখতে আগ্রহী। যে জীবন ফ্ল্যাটবাড়ির খোপে, ছোট হ্যাচব্যাক গাড়ির ভিতরে, শপিং মলের শো-উইন্ডোর বিপুল বিস্তারে, টেলিভিশন বা ইন্টারনেট-এর অহর্নিশ নেটওয়ার্কে, সেই জীবনটাকেই যদি ফিরে পাওয়া যায় শিল্পের স্ব-ভাবে, সেই সুযোগ আঁকড়ে ধরছেন তাঁরা।
তুলনায় ঈষৎ বয়স্ক ক্রেতা, যাঁদের যৌবন আচ্ছন্ন করে রেখেছিলেন গণেশ পাইন বা যোগেন চৌধুরী, তাঁরা যখন দেখছেন যে সাধ্যের দামে হাতের নাগালে সেই সব শিল্পীর কাজ, প্রিন্ট-টিন্ট নয়, রীতিমতো স্বাক্ষরিত কাজ, তাঁরা এগিয়ে যাচ্ছেন। কেনার পরে এক লহমা হাত রাখছেন কাজটির গায়ে। কেমন একটা আশ্চর্য গন্ধ আসছে না? স্বপ্ন সফল হওয়ার ঘ্রাণ!
‘আমরা আসলে এটুকুই চাই, শিল্প আর জনসাধারণের মধ্যে একটা সেতু গড়ে উঠুক! না হলে এমন জলের দামে কাজ বিক্রি করে তো আর লাভ হওয়ার কথা নয়, কিন্তু যে লাভটা হয়, তাকে ঠিক টাকার অঙ্কে বিচার করলে চলে না। করা যায়ও না সেটা’, বলছেন সিমা গ্যালারির অধিকর্তা রাখী সরকার, ‘ধরুন, কারও মেয়ের জন্মদিন। নানা রকম উপহার তো দেবেনই। ধরা যাক, তার হাতে একটা ছোট্ট ছবি তুলে দিলেন। বা ছোট্ট একটি ভাস্কর্য! সে অবাক হয়ে একটু দেখল, দেখতে দেখতে তার সঙ্গে সেই কাজটার একটা যোগাযোগ তৈরি হল। যিনি দিলেন, যে পেল এবং যে শিল্পকাজটি দেওয়া হল, সেই তিনটি বিন্দু নিয়ে তৈরি হল একটি ত্রিভুজ। সেই জিনিসটা এই ‘আর্ট মেলা’তে হয়। আয়োজনটা সেখানেই সার্থক।’
এই সার্থকতাই একটি দৃষ্টান্ত যে জনপরিসরে ক্রমে প্রবেশ করছে শিল্পবোধ। শিল্পের চেতনা। দেওয়াল রং করানোর সময় যদি সাদামাটা ব্রাশের বদলে রোলার ব্রাশ-এর কথা ভাবা হয়, তা হলে সেই নিপুণ ফিনিশ করা দেওয়ালে কয়েকটি শিল্পকাজই বা নয় কেন? কেন এই ভাবনাটি আসবে না যে, ক্যালেন্ডারের পাশাপাশি অন্য রকম একটি ছবি যদি এক লহমা অন্য কোনও চিন্তার আভাস রাখে, কেন সেই ভাবনাটিকে গ্রহণ করা হবে না রোজকার জীবনযাপনে?
এখনও কলকাতার কোনও সেলুনে ঢুকে বিকাশ ভট্টাচার্যের কোনও কাজের প্রিন্ট দেখতে পাওয়া হয়তো কার্যত অসম্ভব, কিন্তু শিল্পরুচিও রাতারাতি বিকশিত হয় না মোটেই। সময় লাগে। প্রস্তুতি লাগে। শিল্পকে মুষ্টিমেয় কিছু চর্চাকারী মানুষের গণ্ডি ছাড়িয়ে জনতার দরবারে নিয়ে আসার একটি আয়োজন লাগে। নভেম্বরের অন্তিমে কলকাতা তেমনই একটি কর্মকাণ্ডের স্মৃতি আঁকড়ে থাকল। |
|
|
|
|
|