অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার আগে গুরুদক্ষিণা দিয়ে যাচ্ছেন সচিন
মুম্বইয়ের বান্দ্রা-কুর্লা কমপ্লেক্সে শনিবার সন্ধেবেলা এক অভিনব ক্রিকেটআড্ডা বসছে। আড্ডা না বলে অবশ্য সংবর্ধনা বলা যায়। সংবর্ধনা না বলে অবশ্য উৎসব বলা যায়। উৎসব না বলে অবশ্য গুরুদক্ষিণা বলা যায়।
জন্মদিনের অনুষ্ঠান। ঊনআশি বছর বয়সি গুরুতর অসুস্থ এক বৃদ্ধের। তাঁকে ঘিরে থাকবেন সন্তানসন্ততিসম জনা একশো ছাত্র। যাঁদের অনেকেরই এখন চুলে পাক ধরেছে। যাঁদের ছেলেমেয়েরা কলেজেটলেজে পড়ছে। যাঁদের ক্রিকেট মাঠ থেকে হয় অবসর হয়ে গিয়েছে। অথবা হওয়ার উপক্রম হয়েছে।
কিন্তু জীবনের যে কোনও স্তরে শিক্ষাজগতের আহ্নিক গতি হল, একবার যে ছাত্র, সে বরাবরই ছাত্র! একবার যিনি সম্মানিত শিক্ষক, তিনি চিরজীবনের সম্মানিত শিক্ষক!
দিন কয়েক আগে তর্কযোগ্য ভাবে ভারতীয় ফুটবলের সেরা শিক্ষক প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বলছিলেন, “গুরুর প্রতি সচিন তেন্ডুলকরের আচরণ দেখলে অভিভূত লাগে। এত বছর পরে এই পর্যায়ে পৌঁছেও শিক্ষকের প্রতি ওর শ্রদ্ধা কতটা আন্তরিক। এমন শিষ্য পাওয়ার জন্য গুরু হওয়া সার্থক।” পিকে কোনও ব্যক্তিগত বেদনা থেকে বলছিলেন কি না জানার উপায় নেই। তবে তেন্ডুলকরের সাম্প্রতিক সৌজন্যে যে ভারতব্যাপী কোচেরা ফের আপ্লুত হবেন তা ধরেই নেওয়া যায়।
শনিবার রমাকান্ত আচরেকরের জন্মদিন। জন্মদিনে মুম্বই থাকলে সচিনের রুটিন হল, নিয়ম করে শিবাজি পার্কের কাছে স্যরের বাড়ি যাওয়া। বিশেষ পেঁড়া নিয়ে যাওয়া। নিজের হাতে স্যরকে খাইয়ে ফেরা। বছরখানেক আগেও জন্মদিনের পার্টিতে সচিনকে সঙ্গ দিতেন বিনোদ কাম্বলি। এখন মুম্বই ক্রিকেটের রাম আর শ্যামের সেই সম্পর্ক নেই। তবু আলাদা করে প্রিয় শিক্ষকের বাড়ি যাওয়া কেউ ছাড়েননি।
তখন সারদাশ্রমের শিক্ষক আর ছাত্র।
এ বার অবশ্য উৎসবের মাত্রা অনেক বেশি। সচিনের উদ্যোগে তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু অতুল রানাডে জমকালো ভাবে প্রিয় কোচের জন্মদিন পালনের তোড়জোড় করছেন। রানাডেও আচরেকরের শিষ্য। কোনও কোচের বিশ্বব্যাপী এমন জন্মদিনের উৎসব কখনও পালন হয়েছে কি না সন্দেহ। যেখানে যে স্কুলে তিনি কোচিং করাতেন, তার প্রাক্তন একশো জন ছাত্র ক্রিকেটার মিলিত হচ্ছেন কোচকে সংবর্ধনা জানাতে। মুম্বই ক্রিকেটে এই মুহূর্তে যিনি বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু সেই অজিত আগরকর রাতে দিল্লি ফ্লাইট ধরার আগে ফোনে বললেন, “আজ রাত্তিরে পৌঁছে কাল সকালে মুম্বই ফিরব। স্যরের জন্মদিন আর এমন লোভনীয় রি-ইউনিয়ন। কে ছাড়বে?”
অনুষ্ঠান সম্পর্কে জানতে যাওয়ায় অবশ্য আগরকরকে খুবই বিস্মিত শোনাল। গোটা ব্যাপারটাই যেহেতু হচ্ছে মিডিয়াকে সম্পূর্ণ অন্তরালে রেখে। শুধু শিষ্যরা আর গুরু। টিভি ক্যামেরা আর ফ্লাশবাল্বের ঝলকানিতে অনুষ্ঠানের পবিত্রতা ব্যাহত হতে পারে বলে উদ্যোক্তাদের আশঙ্কা। তাই সচিন পরিকল্পনায় এত সক্রিয় অংশ নিয়েও কোথাও মুখ খোলেননি।
শিবাজি পার্কে নিয়মিত কোচিং ছাড়াও আশির দশক থেকে দীর্ঘদিন আচরকর ছিলেন সারদাশ্রম বিদ্যামন্দির স্কুলের ক্রিকেট কোচ। এই স্কুলের হয়ে খেলেই সচিন-কাম্বলির সেই বিশ্বরেকর্ড। এই স্কুল থেকে এত মুম্বই আর ভারতীয় ক্রিকেটারের উত্থান। পশ্চিম দাদারের এই স্কুল বিশ্বব্যাপী বিখ্যাত হয়ে গিয়েছে। গুগল সার্চে ছড়িয়ে গিয়েছে একমাত্র সচিন তেন্ডুলকরের জন্য।
সচিন বিশ্বকাপ চলাকালীন এক বার গুরুর সঙ্গে তাঁর বাড়িতে দেখা করতে গিয়েছিলেন। আচরেকর তখন তাঁকে পরামর্শ দেন, “বাবা, দেশব্যাপী যা চলছে। তুই শুধু মাথাটা ঠান্ডা রাখিস।” এর পর বিশ্বকাপ ফাইনালে প্রিয়তম শিষ্যের খেলা দেখার ইচ্ছে ছিল আচরেকরের। কিন্তু ভগ্নস্বাস্থ্যের জন্য ওয়াংখেড়ে যাওয়া হয়ে ওঠেনি।
দাদার থেকে বান্দ্রা-কুর্লা অন্তত কুড়ি কিলোমিটার। যিনি বিশ্বকাপ ফাইনালেই যেতে পারেননি। যাঁর এখন হাঁটাচলা করতে কষ্ট হয়। তাঁকে উৎসবের মঞ্চে নিয়ে যাওয়া হবে কী করে? আগরকররা চিন্তিত।
মুম্বই ক্রিকেটমহলের অবশ্য খবর, সচিন সব ব্যবস্থা করে ফেলেছেন। যেমন ধুমধাম করে তাঁরা দলবল মিলে জন্মদিন পালন করতে চান, সেটা দাদারে কোচের অপরিসর বাড়িতে সম্ভব নয়। তা ছাড়া কোচের বয়সও হয়েছে। কে বলতে পারে কবে আছেন, কবে নেই। হয়তো সে জন্যই আশিতম জন্মদিনের জন্য অপেক্ষা না করে এ বারেই কৃতজ্ঞতার গুরুদক্ষিণা ফের দিয়ে যাচ্ছেন সচিন।
গুরু এবং তাঁর প্রিয়তম শিষ্য একজোট। স্কুলের সব প্রাক্তনীরা তুমুল উৎসাহের সঙ্গে হইচই-হট্টগোল করবেন বলে তাকিয়ে আছেন। এঁদের কেউ কেউ বললেন, “স্যর বাজে আউট হলে চড়চাপড়ও দিয়েছেন। সে সব নিশ্চয়ই রোমন্থন হবে।” এঁদের কথা শুনে মনে হচ্ছে, বার্থ ডে পার্টির রিংটোন যেন পুরনো সেই দিনের কথা ভুলবি কী রে হায়...।
সেখানে থাকবেন না শুধু আচরেকরের দ্বিতীয় প্রিয়তম শিষ্য। বিনোদ কাম্বলি। তাঁকেও নেমন্তন্ন করা হয়েছে। কিন্তু তিনি দিল্লিতে টিভি-র কাজে ব্যস্ত বলে আসতে পারছেন না। স্টার নিউজে বিশেষজ্ঞের মতামত দেন কাম্বলি। তারই ফাঁকে শুক্রবার আনন্দবাজারকে বললেন, “আরে, আমি দিল্লি থেকে যাব কী করে? ওয়ান ডে সিরিজ কভার করছি তো। অতুল রানাডে আমাকে ফোন করেছিল ঠিকই। দারুণ উদ্যোগ। কিন্তু অসুবিধেটা জানিয়ে দিয়েছি।” কাম্বলিকে বলার কোনও মানে হয় না যে, শনিবার মোটেও ওয়ান ডে সিরিজের কোনও খেলা নেই। টিভি স্টুডিওয় তাঁর থাকার কথাই নয়। এবং তাঁর প্রাক্তন এক সতীর্থ আগরকর, এখন তিনি যে দিল্লিতে আছেন, সেখান থেকেই সকালে মুম্বই ফিরছেন। কাম্বলিকে এটাও বলার মানে হয় না, তিনি জানেনই। পুরনো সময় হলে যে, তাঁর কাছে নেমন্তন্নর ফোনটা অতুল রানাডের চেয়ে সামান্য বেশি বিখ্যাত কেউ করতেন।
কাম্বলি বলছিলেন, “ওদের আড্ডায় নিশ্চয়ই সেই ঘুড়ির ঘটনাটা উঠবে। সচিন ১৪০ ব্যাটিং, আমি ১৩৮। এই সময় স্কুল ম্যাচে মাঠের মধ্যে একটা ঘুড়ি এসে পড়েছিল। আমি যত টেনে নামাতে যাচ্ছি, তত সেটা বোঁ বোঁ করে ওপরে উঠে যাচ্ছে। সাত-আট মিনিট এ রকম চলল। সচিন আজও বলে থাকে, ক্রিকেট মাঠে এর চেয়ে মজার ঘটনা ও দেখেনি। আমার অবশ্য মজার সুযোগ ছিল না। খেলার পরে স্যর এক থাবড়া মেরেছিলেন এই বলে, ব্যাটিংয়ের সময় তোকে ঘুড়ি ওড়াতে কে বলেছিল?”
সচিন-ঘনিষ্ঠদের হালফিল কাম্বলি সম্পর্কে যা মনোভাব, তাতে ঘুড়ির ঘটনা জন্মদিনে কেক কাটার সঙ্গে আলোচিত হলে বিস্ময়ের ব্যাপার হবে।
সারদাশ্রম ক্রিকেট স্যরের অধীনে সবুজ মাঠে সব অফুরন্ত আনন্দের ঘটনা প্লেব্যাক হতে হতে। কেক আর মোমবাতির উৎসবের আলোর মধ্যে কোথাও যেন একটা বিচ্ছেদের রেশ থেকেই যাবে। সময় যে একটা মহাআলোচিত আর অবিচ্ছেদ্য বন্ধুত্বের ঘুড়ি কেটে দিয়েছে।




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.