সিনেমা সমালোচনা...
এত আয়োজন তবু দেখা হল কই
ত্যজিৎ রায়, নিকারাগুয়া, গিটার, তাজমহল, বিকিনি, বিল্লা নম্বর ৭৮৬...একটা গামলায় সব একসঙ্গে মাখলে কী হয়? দধিকর্মাও হতে পারে, জগাখিচুড়িও হতে পারে।
কী হয়েছে, সেটাই দেখতে গিয়েছিলাম। অভিজ্ঞতাটা সুখের হল না মোটেই।
সবাই বলছেন, বাংলা ছবিতে এখন পরিবর্তনের ঢল। সেই পরিবর্তনের কান্ডারিদের ছ-ছ’জন পরিচালকের মস্তিষ্ক নাকি জড়িত রয়েছে এই ছবিতে (কোন ছবি, সেটাই বলিনি বুঝি? আরে, ‘জানি দেখা হবে’)। তা সেই ছয় জনার যৌথ উদ্যোগের এই পরিণতি?
কারণের অনুসন্ধান ছেড়ে কার্যের আলোচনাতেই আসি! ছবি দেখে চোখ বুজে যাঁকে চিনে নেওয়া যাচ্ছে, তিনি বিরসা দাশগুপ্তই। স্টাইলাইজেশনের ঝোঁকটা বিরসার আগের ছবি ‘০৩৩’-তেও ছিল। এ ছবিতেও পুরোমাত্রায় আছে এবং সেই স্টাইলাইজেশনের মুনশিয়ানায় বিরসাকে চিনতে পারার মতো চিহ্নও ছড়ানো আছে। কিন্তু তার পর? তার পর যে কী হল, দেবা ন জানন্তি!
অথচ অঞ্জন দত্ত-মমতাশঙ্করের মতো অভিনেতারা ছিলেন (কেন যে ছিলেন!)। অনেক দিন পর রূপা গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো শিল্পীকে পেলাম (কী যে পেলাম!)। ‘২২শে শ্রাবণে’ সদ্য প্রশংসিত অভিনয়ের পরে পরমব্রত আবার পর্দায় (কেন এখনও এই সব চরিত্র?)। অভিনয়ে ফিরলেন শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় (আর কিছু পেলেন না?)। মডেলিং করার স্বপ্ন দেখা নায়িকার ভূমিকায় পায়েল (সর্বক্ষণ চোখ গোল গোল করে রইলেন!)। একটা চরিত্রে অরিজিৎ দত্তও ছিলেন (কিছু করার সুযোগ পাননি)। আর, বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী বা কাঞ্চন মল্লিকের মতো শিল্পীদের যা দশা হয়েছে, সে আর নাই বা বললাম!
জানি দেখা হবে
পরমব্রত, পায়েল, অঞ্জন, মমতাশঙ্কর, রূপা
বিরসা, মনে তো হল, একটা প্রেমের গল্প বলতে চেয়েছিলেন! তা সেটা বলতে গিয়ে প্রেম আর গল্প, এ দু’টোকেই সবার আগে ছেঁটে ফেলে দিলেন? নায়ক-নায়িকার আলাপ হল, তার পরেই দেখলাম তারা পুরোদস্তুর প্রেমিক-প্রেমিকা! প্রেমটা কী ভাবে গড়ে উঠল, জানতে পারলাম না! সুতরাং সেই প্রেমের প্রতি দর্শক হিসেবে আমাদের কোনও মমতাও জন্মাল না। তার পর সেই প্রেম ঠুনকো খেলনার মতো ভেঙেও গেল! কেন? নায়িকার ফটোগ্রাফার আর নায়কের রেকর্ডিং কোম্পানির এক মহিলাকে নিয়ে নায়ক-নায়িকার মধ্যে খিটমিট হচ্ছিল। মডেল গার্লফ্রেন্ডের গায়ক বয়ফ্রেন্ড মদ খেতে খেতে আহত অভিমানে বলে ফেলে, তার বান্ধবী ন্যুড (পরমব্রত বলেছেন, ‘নিউড’, পায়েল বলছেন, ‘নুড’) ফটোশু্যট করছে! সেই কথা শুনে নায়িকা চটে কাঁই! ব্যস, সব শেষ! এই রকম একটা ‘মহান’ প্রেমকাহিনির ভবিষ্যৎ নিয়ে এতগুলো লোক যে আদৌ চিন্তিত হচ্ছে কেন, সেটাই মাথায় ঢোকে না! বলতে ইচ্ছে করে, ‘গেছে গেছে, আপদ গেছে! আগে বাড়ো!’
মুশকিল হচ্ছে, এই ‘আগে বাড়া’র ইচ্ছেটাই চিত্রনাট্যে কোত্থাও ছিল বলে মালুম হয় না! একটা-দু’টো মুহূর্ত তৈরি হয়, আশা জাগে এই বার খেলা জমল বুঝি! হরি হরি! পরের মুহূর্তেই গল্পটা আবার গোঁত্তা খেয়ে পড়ে! ছবিতে ঈশ্বর-রূপী অঞ্জন দত্তের প্রবেশ-পর্বটাই ভাবুন! মনে হচ্ছিল, এই বার একটা কিছু হবে! কোথায় কী? না দাঁড়াল অঞ্জন-মমতার আখ্যান, না জমল পরম-রূপার গল্প! আর ফটোগ্রাফার প্যাটের (শিবপ্রসাদ) সঙ্গে অঞ্জনদের পাঙ্গা নেওয়ার দৃশ্যপর্বটা তো ছেড়েই দিন! ‘দস্যু মোহন’ সিরিজের গল্পেও এর চেয়ে বেশি লজিক থাকে!
সারাক্ষণ ‘গল্প’ আর ‘লজিক’ নিয়ে কথা বলছি বলে ভুরু কুঁচকোচ্ছেন? বিশ্ব সিনেমার তাবড় উদাহরণ ঘেঁটে মনে করিয়ে দেবেন, ছবিতে গল্পটা গৌণ হতেই পারে! গল্প না থাকতেও পারে! লজিক বিসর্জন দেওয়াটাই স্টাইল হতে পারে! কিন্তু দু’লাইন করে ভিস্যুয়াল কোলাজ, দু’লাইন করে গল্প বলার চেষ্টা আর দু’লাইন করে গান, গানের মধ্যে আবার ভিস্যুয়াল কোলাজ এটা নিশ্চয়ই কোনও পন্থা হতে পারে না! গানগুলো আলাদা করে বেশ ভাল শ্রীজাত এবং অংশুমানের লেখা ভাল, ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত এবং নীল দত্তের সুর ভাল, অনুপম-শ্রেয়ার গাওয়া ভাল। কিন্তু ছবিতে গানের ব্যবহারকে ভাল বলতে পারছি না। যখন তখন গান এসে পড়লে তাকে ভাল বলা যায়ও না। মজার সংলাপ আছে। শীর্ষ রায়ের ক্যামেরায় দু’চারটে মুহূর্ত ভাল (রবীন্দ্রনাথকে একচোখো করে দিল শশার টুকরো, সেটা যেমন একটা)!
ভাবার চেষ্টা করছিলাম, এমনও তো অনেক সময় হয়! দুর্বল ছবিতেও কিছু দৃশ্য, কিছু মুহূর্ত থেকে যায়, যেগুলো খুব অমোঘ ভাবে মনের মধ্যে ধাক্কা মারে! খুব দুঃখের সঙ্গে বলতে বাধ্য হচ্ছি, এখানে সেটাও ঘটল না। তার কারণ বোধহয়, ভাল উপাদানগুলোও কোথাও পরস্পরের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারল না! ক্যামেরা খুব নয়নাভিরাম দৃশ্য রচনা করল! কিন্তু মন বলল না, “এই দৃশ্যটা আমার সারা জীবন মনে থেকে যাবে!” ভাল গান হল! কিন্তু আমাদের ভিতর থেকে কেউ গেয়ে উঠল না যে, “এখানে এই গানটা এসে জাস্ট দারুণ হল!” এত রকম সব ফোটা-আধফোটা প্রেমের জিগির! এক বারও বুকের মধ্যে হু হু করল না! কী করে হবে? সম্পাদনার (বোধাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায়) দেখনদারি চটক দিয়ে তো এই সব ফাটল মেরামত করা যায় না! ঘরের মধ্যে গুচ্ছের দামি জিনিস জড়ো করলেই তো আর ঘর সাজানো হয় না!
পাহাড়ের বুকে স্বপ্নদৃশ্যটায় তো পায়েল-পরমকে ভেবেচিন্তেই ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’র অলকানন্দা-অরুণের মতো করে সাজানো হয়েছে? চিত্রনাট্যটা যদি...হা ঈশ্বর!
এত কিছু বলার পরেও এটা বলতেই হচ্ছে যে, বাংলায় নিউ-এজ ছবির যে ধারা শুরু হয়েছে এই ছবি সেই ধারারই অঙ্গ। হয়তো পরিচালক বিরসার অনেক কিছুই ‘ব্যাটে-বলে’ হয়নি। তাই বলে যে প্রচেষ্টা, যে আয়োজন, যে স্বপ্ন সেটা অস্বীকার করার নয়।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.