কেষ্টপুরে স্বপন মণ্ডল হত্যার ঘটনায় রাজারহাটের তৃণমূল কংগ্রেসের সদ্য প্রাক্তন যুব সভাপতি পার্থ সরকারকে গ্রেফতারের ঘটনায় ওই এলাকায় দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব আরও প্রকট হল। ধৃত পার্থবাবুকে শুক্রবার বারাসত আদালতে তোলা হলে এলাকার বহু তৃণমূল কর্মী সেখানে এসে বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন। সেই দলে ছিলেন স্বপন মণ্ডলের বাবা-মা-দাদা-ভাইও! আদালতে যান মধ্যমগ্রামের দলীয় বিধায়ক রথীন ঘোষও। তিনি অবশ্য কোনও মন্তব্য করেননি।
স্বপন-হত্যার ‘মূল ষড়যন্ত্রকারী’ হিসেবেই পার্থবাবুকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। কিন্তু ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ ভাবে আদালতে দাঁড়িয়ে নিহত স্বপনবাবুর পরিবারের তরফে পরিষ্কার জানিয়ে দেওয়া হয়, ‘নোংরা রাজনীতি’ করে পার্থবাবুকে ফাঁসানো হয়েছে! তিনি ‘নির্দোষ’। স্বপনবাবুর পরিবারের তরফে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে লিখিত অভিযোগে বলা হয়েছে, পার্থবাবুকে ‘ফাঁসানোর’ পিছনে রয়েছেন রাজ্যের শ্রমমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসু। আদালতেও স্বপনবাবুর বৃদ্ধা বাবা-মা সরাসরি জানান, পূর্ণেন্দুবাবুই ষড়যন্ত্র করে পার্থবাবুকে ‘ফাঁসিয়েছেন’।
পূর্ণেন্দুবাবু অবশ্য বলেন, “এ সব তৈরি করা কথা। কেউ কিছু মনে করতেই পারেন। সেটা তাঁর ব্যাপার।” পার্থবাবুকে গ্রেফতার প্রসঙ্গে পূর্ণেন্দুবাবুর প্রতিক্রিয়া, “সকালেই খবরটা পেয়েছি। পুলিশ তাদের মতো তদন্ত করে অপরাধীদের ধরছে। এ ব্যাপারে আমি কোনও মন্তব্য করব না। আইন আইনের মতোই চলবে।” |
ঘটনাচক্রে, উত্তর ২৪ পরগনা জেলার রাজনীতিতে পার্থবাবু শ্রমমন্ত্রীর ‘বিরোধী’ গোষ্ঠীভুক্ত বলেই পরিচিত। ঘটনা জানাতে এ দিন সকালে ধৃত পার্থবাবুর স্ত্রী মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে তাঁর কালীঘাটের বাড়িতে গিয়েছিলেন। তবে তাঁর সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর দেখা হয়নি।
খুনের ঘটনায় পার্থবাবুকে ‘ফাঁসানো’ হয়েছে বলে মনে করছেন ওই এলাকার সাংসদ তথা কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী সৌগত রায়ও। এ দিন দিল্লি থেকে তিনি বলেন, “স্বপন আমাদের দলের কর্মী আর পার্থ দলের নেতা। নির্বাচনে পার্থ আমার হয়েও প্রচারও করেছে। স্বপন-খুনের পর পার্থই প্রতিবাদে নামে। খুনের ঘটনায় ওকে গ্রেফতারের কথা জানা মাত্রই আমি পুলিশ কর্তাদের ফোন করি। এ সব মিথ্যা চক্রান্ত।” চক্রান্ত কারা করছেন, তাঁরা তৃণমূলের কি না, জানতে চাওয়ায় সৌগতবাবু বলেন, “যারা সমাজবিরোধী, তারা চায় না স্বপনের আসল খুনিরা ধরা পড়ুক। এরা দলের লোকও হতে পারে।” বারাসতের সাংসদ কাকলি ঘোষদস্তিদারও বলেন, “পার্থর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। দলের মধ্যে যাঁরা নোংরামি করছেন, তাঁদের দিকে দিদি (মুখ্যমন্ত্রী) লক্ষ্য রাখছেন।”
ঘটনাপ্রবাহ যে দিকে গড়াচ্ছে, তা নিঃসন্দেহে শাসক দলের পক্ষে ‘অস্বস্তিকর’। প্রসঙ্গত আজ, শনিবার গোটা উত্তর ২৪ পরগনা জেলার দলীয় নেতৃত্বকে নিয়ে বৈঠকে বসছেন দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মুকুল রায়। সেখানে রাজারহাট এবং সিন্ডিকেট নিয়ে কী আলোচনা হয়, তা নিয়ে শাসক দলের একাংশে স্বভাবতই কৌতূহল তৈরি হয়েছে।
বস্তুত, কেষ্টপুরে স্বপন-হত্যার পর যখন রাজারহাটে ইমারতি দ্রব্য সরবরাহের সিন্ডিকেট নিয়ে তৃণমূলের ভিতরের লড়াই এবং দলের একাংশের দুর্নীতির বিষয়টি সামনে এসে পড়েছিল, তখন জেলার ‘পর্যবেক্ষক’ হিসেবে খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক দু’পক্ষের মধ্যে বিষয়টি মিটিয়ে ফেলতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। দলের শীর্ষনেতৃত্বের তরফে তাঁর উপর ওই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। কারণ, মমতা-সহ দলের প্রথম সারির নেতারা এই বিষয়ে নিশ্চিত যে, জ্যোতিপ্রিয় আর্থিক দুর্নীতিতে কোনও ভাবেই জড়িত নন। কিন্তু ক্রমশই দলের যুযুধান দুই গোষ্ঠী প্রকাশ্যে বিষয়টিতে জড়িয়ে পড়ে। জনমানসে দলের এবং তাঁর ‘ভাবমূর্তি’ ক্ষুন্ন হচ্ছে দেখে মমতা নিজেই বিষয়টিতে কঠোর হয়ে হস্তক্ষেপ করেন। বৃহস্পতিবার বিকেলে পূর্ণেন্দুবাবু, জ্যোতিপ্রিয় এবং মুকুলবাবুকে নিয়ে তিনি মহাকরণে দীর্ঘ বৈঠক করেন। মুখ্যমন্ত্রী সরাসরি জানিয়ে দেন, দলের কেউ সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত থাকলে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হবে। ইট-বালির ব্যবসা কেউ চাইলে করতেই পারেন। কিন্তু সে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে দল ছাড়তে হবে। |
বৃহস্পতিবারই গভীর রাতে পার্থবাবুকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তার পরেই ঘটনা দ্রুত অন্য দিকে মোড় নেয়। দলের মধ্যে যে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব সামাল দিতে হাল ধরেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী, তা আরও প্রকট হয়ে পড়ে। দলের কর্মীদের একাংশ প্রকাশ্যেই পূর্ণেন্দুবাবুর বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে থাকেন। গোটা ঘটনায় ‘অন্য মাত্রা’ দেয় নিহত স্বপনের পরিবারের অভিযোগ।
পূর্ণেন্দু-শিবির অবশ্য পার্থবাবুর গ্রেফতার নিয়ে বিস্তারিত ভাবে মুখ খুলতে এর পর ছয়ের পাতায় চায়নি। মঙ্গলবার জ্যোতিপ্রিয়র দেওয়া যে ‘নৈশভোজের’ কথা পূর্ণেন্দু-শিবির থেকে দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে জানানো হয়েছিল, আজ খাদ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ মহল তা অস্বীকার করেছে। তাদের দাবি, ওই নৈশভোজ জ্যোতিপ্রিয় আদৌ দেননি এবং তিনি ছিলেনও না। খাদ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ এক তৃণমূল নেতার কথায়, “জেলার পর্যবেক্ষক হিসেবে জ্যোতিপ্রিয় চাইছেন বিষয়টির দ্রুত নিষ্পত্তি হোক।”
তবে নিষ্পত্তি হওয়ার পরিবর্তে বিষয়টি আরও ‘গোলমেলে’ হয়েছে পার্থবাবুর গ্রেফতারিকে ঘিরে। দলের কর্মীদের একাংশের বিক্ষোভ তো বটেই, এ দিন আদালতে দাঁড়িয়ে নিহত স্বপনের বৃদ্ধা বাবা-মা প্রকাশ্যেই বলেন, “ও খুনি নয়! ওকে ফাঁসানো হয়েছে। এ সব নোংরা রাজনীতি। হুজুর, এর ফাঁসি হলে অনর্থ হবে। আমার ছেলের আত্মা শান্তি পাবে না।” স্বপনবাবুর বাবা শিবুপদ, মা শেফালী, দাদা শান্তিরঞ্জন ও ভাই লব মুখ্যমন্ত্রীকে এক লিখিত অভিযোগে পার্থবাবুকে মিথ্যা মামলায় ‘ফাঁসানোর’ জন্য সরাসরি দায়ি করেছেন পূর্ণেন্দুবাবুকেই! এ দিন আদালত চত্বরে শেফালীদেবী বলেন, “পার্থ নির্দোষ। আমার ছেলেকে ও খুন করতে পারে না! এতে আমার ছেলের আত্মার শান্তি হবে না।” শিবুপদবাবু বলেন, “পূর্ণেন্দু বসু চক্রান্ত করে পার্থকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়েছেন। সে কথা জানাতেই আমরা আদালতে ছুটে এসেছি।”
স্বপনবাবুর পরিবারের তরফে মুখ্যমন্ত্রীকে লিখিত অভিযোগে বলা হয়েছে, প্রথম থেকেই তাঁদের পরিবার তৃণমূলের হয়ে লড়ছে। রাজারহাট-গোপালপুর এলাকায় বামেদের ক্ষমতাচ্যুত করার পিছনে স্বপনের ভূমিকার কথাও জানানো হয়েছে। স্বপন-হত্যার ঘটনা উল্লেখ করে লিখিত অভিযোগে বলা হয়েছে, ‘যারা সিন্ডিকেট ব্যবসা ও সমাজবিরোধী কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত, তারাই এই কাণ্ড করেছে।
কিন্তু এই ঘটনায় পার্থ সরকারকে গ্রেফতার মর্মান্তিক ঘটনা। পার্থ আগাগোড়া আমার ছেলের শুভাকাঙ্খী হিসেবে আমাদের পাশে থেকেছে। সে আমারই এক ছেলে। এক ছেলের মৃত্যুর পর আর এক ছেলে পার্থ দিন-রাত এক করে খুনের প্রতিবাদও করেছে। আমার ছেলের মৃত্যুর ঘটনায় পার্থ মিথ্যা সাজা পেলে, তাঁর ফাঁসি হলে আমার ছেলের আত্মা কোনও দিন শান্তি পাবে না’।
স্বপন-হত্যার সিবিআই তদন্ত দাবি করে অভিযোগে বলা হয়েছে, ‘আমাদের দলের বিধায়ক ও মন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসু আমাদের সমবেদনা জানানো তো দূরের কথা, উল্টে চক্রান্ত করে যে ভাবে পার্থ সরকারকে মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসিয়ে নিজের দোষ ঢাকার চেষ্টা করছেন, তা অন্যায় ও সরকারের পক্ষে লজ্জাকর’।
|