ওঁরা নিছকই খেটে খাওয়া, গরিবগুর্বো লোক। কেউ দিনমজুর, কেউ বা রিকশা চালান। কিন্তু কেষ্টপুর-রাজারহাটে ‘সিন্ডিকেট-জুলুমবাজি’র থাবা থেকে ওই দিন-আনি-দিন-খাই মানুষগুলোরও নিস্তার নেই!
এর কারণ, গরিবদের জন্য পাকা বাড়ি তৈরির কেন্দ্রীয় প্রকল্পে সরকার ওঁদের স্ত্রীদের নামে প্রায় আড়াই লক্ষ টাকা করে বরাদ্দ করেছে! ওঁদের অভিযোগ, সিন্ডিকেট থেকে বাড়ির তৈরির মালপত্র না-কিনলে বাড়ির কাজই বন্ধ করে দেওয়া হবে বলে তাঁদের প্রতিনিয়ত হুমকি দেওয়া হচ্ছে।
আর এই অভিযোগ নিয়েই মঙ্গলবার স্থানীয় তৃণমূল কাউন্সিলরের দ্বারস্থ হল হতদরিদ্র ওই জনতা।
বস্তুত রবিবার কেষ্টপুর মোড়ে স্বপন মণ্ডল খুন হওয়ার পরেই এলাকাবাসী সিন্ডিকেটের ‘জুলুমের’ প্রতিবাদে সরব হয়েছেন। সোমবার মুখ খুলেছিলেন স্থানীয় ছোট-বড় আবাসন সংস্থার মালিক ও মধ্যবিত্ত বহু সাধারণ লোক। কিন্তু এ দিন সকালে যাঁরা রাজারহাট-গোপালপুর পুরসভার ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শ্যামল চক্রবর্তীর কাছে এসে ক্ষোভ জানালেন, তাঁরা সবাই দরিদ্র শ্রেণির। কাউন্সিলরের কী বক্তব্য?
শ্যামলবাবু বলেন, “ওঁদের অভিযোগ, স্থানীয় কয়েকটি সিন্ডিকেট তাঁদের উপরে জুলুমবাজি চালাচ্ছে, ভয় দেখাচ্ছে। স্বপনের মৃত্যুর পরে ওঁরা মুখ খোলার সাহস পেয়েছেন। ওঁরা যেখানে থাকেন, সেই আনন্দনগর এলাকাটা কেষ্টপুরের নির্জন, জলা জায়গায়। জমি নিয়ে বিবাদের জেরে দেড় বছর আগে ওখানেই জোড়া খুন হয়েছিল। তার পরে কেউ ভয়ে মুখ খোলার সাহস পাননি।” শ্যামলবাবু জানাচ্ছেন, তিনিই অভিযোগকারীদের সাহস জুগিয়ে সিন্ডিকেটের জুলুমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে বলেছেন। |
রাজারহাট-গোপালপুর পুরসভা-সূত্রের খবর: ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের ৫ নম্বর কলোনি, আনন্দপুর, শান্তিময়নগর, গোবিন্দনগরে গরিবদের জন্য ৩৪২ বর্গফুটের ২৩৫টি একতলা বাড়ি তৈরি হচ্ছে, কেন্দ্রীয় সরকারের ‘বেসিক সার্ভিস ফর দ্য আরবান পিপল’ (বিএসইউপি) প্রকল্পের আওতায়। এক-একটা বাড়ির খরচ ধরা হয়েছে ২ লক্ষ ৭০ হাজার টাকা। বাড়ির মালিককে দিতে হয় ৩০ হাজার। বাকি ২ লক্ষ ৪০ হাজার টাকা চেকের মাধ্যমে খেপে খেপে বাড়ির মালিককে দেওয়া হয়। মালপত্র কেনা থেকে শুরু করে নির্মাণের কাজ করাতে হয় তাঁকেই। ভিত তৈরির জন্য প্রথম ধাপে মেলে ৪০ হাজারের চেক। ভিত সম্পূর্ণ হলে পরের ধাপের চেক আসে। এ ভাবে পাঁচটি ধাপে পরিবারটিকে প্রায় আড়াই লক্ষ টাকা জোগায় সরকার। পুরো টাকাটাই মঞ্জুর হয় গৃহকর্ত্রীর নামে।
এবং এই টাকার উপরেই সিন্ডিকেটের জুলুমবাজদের নজর পড়েছে বলে অভিযোগ। কী রকম?
এ দিন সেই ‘জুলুমের’ বিবরণ দিয়ে আনন্দপুরের এক দিনমজুর বলেন, “ভিতের চল্লিশ হাজার যে দিন হাতে পেলাম, সে রাতেই এক দল ছেলে বাড়িতে এসে হাজির! এক জন হুকুম দিল, সিন্ডিকেট অফিসে গিয়ে দেখা করতে হবে। গেলাম। ওখানে বলা হল, বাড়ি তৈরির সব মাল ওদের থেকে কিনতে হবে।
না-হলে কপালে দুঃখ আছে। হুকুম না-মেনে উপায় কী? অগত্যা অত্যন্ত খারাপ মাল বেশি দাম দিয়ে কিনে চলেছি। পরিমাণেও কম দেওয়া হচ্ছে।”
এই পরিস্থিতিতে বরাদ্দ টাকায় কী করে বাড়ি শেষ করবেন, ভেবে পাচ্ছেন না তিনি। বলছেন, “ওদের মাল কিনতে গিয়ে চল্লিশ হাজার টাকায় ভিত শেষ করতে পারিনি।” শ্যামলবাবুও জানাচ্ছেন, “ভিত হয়ে গেলে পুরসভাকে তা দেখিয়ে পরের ধাপের টাকা চাইতে হয়। এমন চলতে থাকলে প্রকল্পটাই বানচাল হয়ে যেতে পারে।”
বিএসইউপি-তে টাকা মঞ্জুর হওয়া এলাকার অন্যান্য বহু বাসিন্দার মুখেও একই কথা। তাঁদের অভিযোগ, সিন্ডিকেটের ফতোয়া না-মানায় এক রিকশাচালককে মারধর করা হয়েছে। তবে অভিযোগকারীরা কেউই নিজের নাম বলতে চাননি। আতঙ্ক ওঁদের এতটাই যে, অনেকে হাতজোড় করে মিনতি করেছেন, ছবি যেন না-তোলা হয়।
কারা চালাচ্ছে ওই সব সিন্ডিকেট?
অভিযোগ: নিউটাউন-রাজারহাটে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা নানা ক্লাবের আড়ালে অধিকাংশ সিন্ডিকেট কাজ চালাচ্ছে। বহু সিন্ডিকেট অবশ্য নিজেরাই অফিস খুলেছে। শ্যামলবাবুর অভিযোগ, “সিপিএম থেকে এসে এক দল তোলাবাজ রাতারাতি নিজেদের তৃণমূল হিসেবে দাবি করে সিন্ডিকেট গড়ে জুলুম চালাচ্ছে। ব্যাপারটা দলের নেতাদের জানিয়েছি। পুরসভার চেয়ারম্যানকেও সব বলেছি।” পুর-কর্তৃপক্ষ কী বলেন?
রাজারহাট-গোপালপুর পুরসভার চেয়ারম্যান তথা সিপিএম নেতা তাপস চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “এর সঙ্গে সিপিএমের কোনও সম্পর্ক নেই। তৃণমূলের লোকজনই এই সব করছে। বিএসইউপি-র কাজ নিয়ে যাতে জুলুমবাজি না হয়, সে জন্য আমরা কাউন্সিলরদের সতর্ক করে দিয়েছি। পুলিশকেও জানিয়েছি।”
এ দিকে রাজারহাট-নিউটাউনে‘সিন্ডিকেটের’ রমরমার প্রসঙ্গে রাজ্যের এক মন্ত্রীর নামও বিভিন্ন মহল থেকে উঠে আসছে। সেই শ্রমমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসু এ দিন বলেন, “তৃণমূলের সিদ্ধান্ত, দলের কেউ প্রোমোটারি সংক্রান্ত কোনও কাজ করতে পারবেন না। যারা করছেন, তারা দলবিরোধী কাজ করছেন। আমরা সিন্ডিকেটের জুলুম সংক্রান্ত প্রচুর অভিযোগ পেয়েছি। কেউ এমন কিছু জানালেই সংশ্লিষ্ট থানায় অভিযোগ করা হয়েছে।” পুলিশের ভূমিকা কী?
উত্তর চব্বিশ পরগনার পুলিশ সুপার চম্পক ভট্টাচার্য এ দিন বলেন, “সিন্ডিকেটের জুলুম কোনও ভাবেই বরদাস্ত করা হবে না। রাজারহাটে এ জাতীয় অভিযোগ আগেও মিলেছে। অভিযোগ পাওয়া মাত্র আইন মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।” কিন্তু যাঁরা ভয়ে নিজেদের নাম পর্যন্ত বলতে রাজি হচ্ছেন না, তাঁরা কোন ভরসায় পুলিশের কাছে গিয়ে অভিযোগ জানাবেন? এসপি-র আশ্বাস, “কেউ নাম-পরিচয় গোপন করেও অভিযোগ জানাতে পারেন। থানায় তেমনই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।”
স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশ অবশ্য অন্য রকম কথা বলছেন। তাঁরা জানিয়েছেন, অনেকেই থানায় অভিযোগ জানাতে গিয়েছিলেন। কিন্তু থানাই ওঁদের পরামর্শ দিয়েছে তোলাবাজদের সঙ্গে ‘মিটমাট’ করে নিতে! |