শিলদা, জ্ঞানেশ্বরীতে মানবাধিকার কোথায় ছিল, প্রশ্ন মুখ্যমন্ত্রীর
প্রথম গুলি তো চালিয়েছিল ওরাই
খোলা মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি জনতার উদ্দেশে প্রশ্ন ছুড়লেন “বহু লোককে খুন করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। সরকার যদি সব জেনে চুপ করে বসে থাকত, আপনারা কি ক্ষমা করতেন?”
রবিবার সন্ধ্যায় বেহালা চৌরাস্তায় ভিড়ে ঠাসা তৃণমূলের উপনির্বাচনী সভা থেকে জনতা সমস্বরে জবাব দিল, ‘না’! মানুষের এই ‘স্বতঃস্ফূর্ত’ জবাবের অপেক্ষাতেই যেন তিনি ছিলেন। তার পরেই মাওবাদী নেতা কিষেণজির মৃত্যু নিয়ে ‘বিতর্কের’ জবাব দিলেন মুখ্যমন্ত্রী তথা রাজ্যের পুলিশমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই প্রথম প্রকাশ্যে।
কিষেণজির নাম না-করে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “আমি কিছু জানতাম না। দিল্লিতে ছিলাম। ঘটনার কথা সংবাদমাধ্যমের কাছে থেকে জেনে আমি পুলিশকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘তোমরা কি আত্মসর্মপণের সুযোগ দাওনি?’’ পুলিশ আমাকে জানিয়েছে, আত্মসর্মপণের জন্য তিন দিন সময় দেওয়া হয়েছিল। মাইকে পুলিশ বারবার বলেছে। পুলিশ ব্যবস্থা করেছিল ওদের সেফ প্যাসেজ দিতে। ওরা শোনেনি। প্রথম গুলি ওরাই চালিয়েছে।” মুখ্যমন্ত্রীর দাবি, ওই পরিস্থিতিতে পুলিশ ‘ব্যবস্থা না-নিলে অন্তত ৫০০ নিরীহ গ্রামবাসী খুন হয়ে যেতেন। তাঁর সরকার যে ‘স্বচ্ছতা’ নিয়ে কাজ করে তা জানাতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, কিষেণজির মৃতদেহের ময়নাতদন্ত থেকে শুরু করে আইনুনুগ যা যা করার তা করা হয়েছে। তিনি যে মাওবাদী শীর্ষ নেতা কিষেণজিকে ‘জীবিত’ই ধরতে চেয়েছিলেন, ঘটনার অব্যবহিত পরেই ঘনিষ্ঠ মহলে তা জানিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। এ-ও বলেছিলেন যে, পুলিশ বাধ্য হয়েই গুলি চালিয়েছে। কিন্তু কিষেণজির মৃত্যু ঘিরে সব রহস্যের অবসান হয়নি। তাঁকে গ্রেফতার করার পরে অত্যাচার করে ভুয়ো সংঘর্ষে খুন করা হয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছে কিষেণজির পরিবার, কিছু মানবাধিকার সংগঠন এবং কয়েকটি রাজনৈতিক দল। ঘটনার দিন কিষেণজির সঙ্গে সুচিত্রা মাহাতো ছিলেন বলে দাবি পুলিশের। তাদের এ-ও দাবি মাওবাদী নেত্রী আহত। তার পরেও সুচিত্রাকে ধরা গেল না কেন সেই প্রশ্ন উঠছে। যার কোনও সদুত্তর রাজ্যের পুলিশ কর্তাদের কাছ থেকে মেলেনি।
বেহালা চৌরাস্তায় নির্বাচনী জনসভায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রবিবার সন্ধ্যায়। রাজীব বসু
গোটা অপারেশন ঘিরে এই সংশয়ের বাতাবরণে এ দিন মুখ্যমন্ত্রীর প্রকাশ্য ‘ব্যাখ্যা’ যথেষ্টই ‘তাৎপর্যপূর্ণ’। কেন কিষেণজিরা বুড়িশোলের জঙ্গলে জড়ো হয়েছিলেন তার ব্যাখ্যা দিয়ে মমতা বলেন, “পুলিশ আমাকে জানিয়েছে, ওরা আমাকে ও আমার দলের কয়েক জন নেতাকে খুন করার এবং বড় নাশকতা করার পরিকল্পনা করছিল। পুলিশের কাছে তার প্রমাণও আছে।” মেট্রো স্টেশনে হামলা থেকে শুরু করে বড় কোনও বাজার যেখানে ভিড় হয়, সেই সমস্ত জায়গায় মাওবাদীরা নাশকতা করার পরিকল্পনা করেছিল বলে মুখ্যমন্ত্রী পুলিশের কাছ থেকে জেনেছেন। মমতা বলেন, “আমি মরতে ভয় পাই না। মানুষ হয়ে জন্মেছি যখন তখন বীরের মতো বাঁচব! ভয় পেয়ে লুকিয়ে থাকব না।” পাশাপাশি তিনি ‘হুঁশিয়ারি’ দিয়েছেন, “মানুষের রক্ত নিয়ে, মানুষের জীবন নিয়ে খেলবেন না!” সংশ্লিষ্ট মহলের মতে যার মধ্যে এই ‘বার্তা’ই আছে যে মানুষ খুন করে রাষ্টের বিরুদ্ধে লড়তে গেলে তার ‘পরিণতি’র জন্যও প্রস্তুত থাকতে হবে।
কিষেণজিদের ‘আত্মসমর্পণের’ সুযোগ দেওয়া হয়েছিল বলে মুখ্যমন্ত্রী এ দিন দাবি করলেও মাওবাদীরা অবশ্য দাবি করেছে, তাদের পলিটব্যুরো সদস্যকে ‘ভুয়ো সংঘর্ষে ঠান্ডা মাথায়’ খুন করা হয়েছে। মাওবাদীদের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য তথা মুখপাত্র অভয় এ দিন সংবাদমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে বলেছেন, “ভুয়ো সংঘর্ষে কিষেণজিকে হত্যার প্রতিবাদে ২৯ নভেম্বর থেকে ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতিবাদ দিবস পালন করবে মাওবাদীরা। আগামী ৪-৫ ডিসেম্বর ভারত বন্ধেরও ডাক দেওয়া হয়েছে।” অভয়ের আরও বক্তব্য, “কমরেড আজাদের মৃত্যুর সময়ে কুম্ভীরাশ্রু বিসর্জন করা মমতা ক্ষমতায় এসে এক দিকে মাওবাদীদের সঙ্গে আলোচনা করার প্রতিশ্রুতি দেন আর অন্য দিকে কিষেণজির মতো শীর্ষ নেতাকে হত্যা করে নিজের জন-বিরোধী ও ফ্যাসিবাদী মনোভাবের পরিচয় দিয়েছেন। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা, পশ্চিমবঙ্গ ও অন্ধ্রপ্রদেশের যৌথ বাহিনী পরিকল্পনামাফিক ভাবে তাঁকে অনুসরণ করে একটি ভুয়ো সংঘর্ষে হত্যা করে।”
কিষেণজির মৃত্যু নিয়ে এটাই মাওবাদীদের প্রথম প্রকাশ্য বিবৃতি। যদিও প্রায় একই ধরনের অভিযোগ আগেই তুলেছিল বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন। এ দিন সেই সব সংগঠনেরও কড়া সমালোচনা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর বক্তব্য, “আমাকে বেশি মানবাধিকার শেখাতে আসবেন না! পুরুলিয়ার জিতু সিংহ সর্দার, ঝাড়গ্রামে বাবু বোসের খুনের পর ক’টা মানবাধিকার সংগঠন রাস্তায় নেমেছে? শিলদায় সিআরপি ছাউনিতে মাওবাদীরা হামলা চালিয়ে জওয়ান হত্যার পরে বা জ্ঞানেশ্বরী-কাণ্ডে ১৬৬ জনকে খুন করার পরে মানবাধিকার সংগঠন কোনও প্রতিবাদ করেছে কি?” মাওবাদীদের বিরুদ্ধে তিনি কোনও ব্যবস্থা এত দিন নেননি বলে সিপিএমের আক্রমণের জবাবও একই সঙ্গে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর কথায়, “আমি খুন, রক্তপাতের বিরোধী। কেউ খুন হলে আমার খারাপ লাগে। অনেক চেষ্টা করেছি। পাঁচ মাস ধরে অপেক্ষা করেছি। আমি ‘ব্যবস্থা’ নিইনি বলে সিপিএম বদনাম করেছে। আমি চেয়েছি, সবাই সমাজের মূল স্রোতে ফিরে আসুক।”
সমাজের মুল স্রোতে ফেরার জন্য মাওবাদীদের আহ্বান জানিয়ে জঙ্গলমহলে উন্নয়নের প্যাকেজ এবং অন্য দিকে নির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে যৌথ বাহিনীর অভিযান কিষেণজির মৃত্যুকে মমতার এই দ্বিমুখী কৌশলের ‘সাফল্য’ হিসেবেই দেখছে প্রশাসন। মাওবাদী নেতা অভয়ও তাঁর বিবৃতিতে মেনে নিয়েছেন, কিষেণজির মৃত্যু তাঁদের আন্দোলনের পক্ষে ‘একটি বড় ক্ষতি’। কিন্তু তা বলে একের পর এক শীর্ষ নেতাদের হত্যায় মাওবাদী আন্দোলনে ভাটা পড়বে বলে বিভিন্ন মহল থেকে যে দাবি করা হচ্ছে, তা ‘দিবাস্বপ্ন’ বলেই মন্তব্য করেছেন অভয়।
কিষেণজির মৃত্যুর পরেও মাওবাদীরা যে এ রাজ্যে হাত গুটিয়ে বসে নেই, তা এ দিন জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রীও। তিনি জানান, বেহালায় তিন-চার জনের একটি দল ‘নাশকতামূলক’ কাজের পরিকল্পনা করছে। সরকার এই ব্যাপারে ‘কড়া নজর’ রাখছে।
প্রসঙ্গত, এ দিনই মাওবাদীদের সঙ্গে সিপিএমের একাংশের ‘যোগসাজসে’র অভিযোগ তুলেছেন জগদ্দলের তৃণমূল বিধায়ক পরশ দত্ত। তাঁর অভিযোগ, “শনিবার বিকেলে আমার নির্বাচনী কেন্দ্রের অন্তর্গত নারায়ণপুর রথতলায় সিপিএমের কর্মী-সমর্থকরা দলীয় পতাকা নিয়ে মাওবাদী নেতা কিষেণজির স্মরণে মিছিল করেছে। তারা ‘কিষেণজি অমর রহে’ বলে স্লোগানও দিয়েছে।” সিপিএম অবশ্য মাওবাদীদের সমর্থনে তাদের কর্মীদের কোনও মিছিলের কথা স্বীকারই করেনি। সিপিএমের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য তড়িৎ তোপদার বলেন, “আমাদের দলের কর্মীরা এ রকম কোনও মিছিল করেনি। যাঁরা মাওবাদীদের সমর্থনে মিছিল করেন, তাঁরা সিপিএমই নন!”
মুখ্যমন্ত্রী এ দিন সাফ জানিয়েছেন, রাজ্যের উন্নয়নের প্রশ্নে ‘সন্ত্রাসকে প্রশ্রয়’ দেওয়ার কোনও প্রশ্ন নেই। জনতার উদ্দেশে মুখ্যমন্ত্রী প্রশ্ন করেন, “মানুষ আমাকে বলে দিন, মানুষ আমাকে পথ দেখান। কেউ নাশকতামূলক কাজ করলে বা চোখের সামনে সন্ত্রাসমূলক কাজ করলে ছেড়ে দেব?” আবার জনতা সমস্বরে জবাব দেয়, “না।”
কিষেণজি-বির্তকের পরে সম্ভবত জনতার এই ‘সিলমোহর’ই খুঁজছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা!



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.