কিষেণজির মৃত্যুর ধাক্কা সামলে জঙ্গলমহলে সংগঠনের রাশ ধরে রাখতে মরিয়া মাওবাদীরা। গোয়েন্দাদের অনুমান, শূন্যস্থান পূরণ করতে মাওবাদীদের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য তথা কিষেণজির ভাই মাল্লোজুলা বেণুগোপাল রাও ওরফে ভূপতি ওরফে বিবেক ওরফে সোনুর হাতে জঙ্গলমহলের দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে। দলের নির্দেশে বেনুগোপাল যে কোনও সময় ঝাড়খণ্ড সীমানা টপকে এ রাজ্যে পা রাখতে পারেন। এই অবস্থায় কোনও ঝুঁকি না নিয়ে শনিবার সকাল থেকেই পাহাড়-জঙ্গলে অভিযানের তীব্রতা বাড়িয়েছে যৌথ বাহিনী। উদ্বিগ্ন এক পুলিশকর্তার কথায়, “বেণুগোপাল এর আগেও একাধিক বার জঙ্গলমহলে এসেছেন। গ্রামে গ্রামে ঘুরে সভা করেছেন। তাই এলাকার ভৌগোলিক অবস্থান সম্পর্কে কিছুই ওঁর অজানা নয়।”
এক সময়ে যাঁর অঙ্গুলিহেলনে গোটা জঙ্গলমহল চলত, ‘লালগড় আন্দোলন’কে সামনে রেখে আদিবাসীদের একজোট করে পুলিশ-প্রশাসনকে কার্যত ঠুঁটো বানিয়ে দিয়েছিলেন যে কিষেণজি, সেই জঙ্গলমহলেই যৌথ বাহিনীর হাতে তাঁর মৃত্যু যে মাওবাদীদের বেশ কয়েক ধাপ পিছিয়ে দিল, এ নিয়ে একমত পুলিশকর্তারা। এক গোয়েন্দাকর্তা বলেন, “মাওবাদীরা খুব সহজে জঙ্গলমহলের রাশ ছাড়বে না। ঝাড়খণ্ড ও ওড়িশায় সংগঠন বাড়ানোর জন্য এই সীমানা-এলাকার দখল রাখা তাদের কাছে অত্যম্ত জরুরি।” তা ছাড়া খুব বেশি দিন ওই এলাকায় সাংগঠনিক কাজকর্ম বন্ধ রাখলে, পরে তা ফিরে পাওয়া মুশকিল হবে। তা ছাড়া, ২ ডিসেম্বর থেকে ‘পিএলজিএ সপ্তাহ’ শুরু হওয়ার কথা। তাই স্কোয়াড সদস্য ও সক্রিয় কর্মীদের মনোবল বাড়াতে এবং সংগঠনের রাশ ধরে রাখতে খুব শীঘ্রই মাওবাদীরা জঙ্গলমহলে বড় ধরনের কোনও নাশকতা ঘটাবে বলে আশঙ্কা পুলিশের। এবং সেই লক্ষ্যেই বেনুগোপাল এ রাজ্যে পা রাখতে পারে বলে মনে করছেন তাঁরা। |
বুড়িশোলের জঙ্গলে এখানেই পড়ে ছিল কিষেণজির দেহ। রবিবার ছবিটি তুলেছেন দেবরাজ ঘোষ। |
কিন্তু গোয়েন্দাদের আর একটি সূত্রের বক্তব্য, জঙ্গলমহলে বিশেষত কিষেণজির মৃত্যুর পরে মাওবাদীরা এতটাই ছন্নছাড়া, যে তারা নিজেদের মধ্যে মোবাইলেও যোগাযোগ রাখছে না। জঙ্গলমহলে সক্রিয় স্কোয়াডগুলির বেশির ভাগ সদস্যই এখন বিভিন্ন জায়গায় গা-ঢাকা দিয়ে রয়েছেন। খবর পাঠাতে গেলেও কোনও বিশ্বস্ত বার্তাবাহকের মাধ্যমেই তা পাঠাচ্ছেন। এই অবস্থায় বাইরে থেকে কেন্দ্রীয় কমিটির কোনও সদস্যকে জঙ্গলমহলের ‘যুদ্ধক্ষেত্রে’ পাঠানোর ঝুঁকি মাওবাদীরা নেবে না বলেই মনে করছেন গোয়েন্দাদের একাংশ। তাঁদের অনুমান, এখন পরিস্থিতির উপরে নজর রেখে অবস্থা একটু নিয়ন্ত্রণে এলে তখন বেনুগোপালকে পাঠানোর কথা ভাববে তারা। তবে পরবর্তী কালে বেনুগোপালের হাতেই যে জঙ্গলমহলের দায়িত্ব দেওয়া হবে, সে ব্যাপারে এক রকম নিশ্চিত কেন্দ্রীয় ও রাজ্য গোয়েন্দারা।
বেনুগোপালকে নিয়ে ভাবনার মধ্যেই সুচিত্রা মাহাতোকে নিয়ে বিভ্রান্ত বাড়ছেই। টানা তিন দিনের তল্লাশির পরেও এই মাওবাদী নেত্রীর এখনও কোনও খোঁজ পায়নি যৌথ বাহিনী। পুলিশের দাবি, বৃহস্পতিবার বিকেলের গুলির লড়াইয়ে আহত হয়েছেন সুচিত্রা। কিন্তু কী ভাবে তিনি আহত অবস্থায় সংঘর্ষস্থল ছেড়ে পালালেন, তার সদুত্তর দিতে পারেনি পুলিশ। গোয়েন্দাদের ধারণা, আহত সুচিত্রা কাছাকাছি কোনও গ্রামেই আশ্রয় নিয়েছেন। সেই মতো আশপাশের
গ্রামগুলিতে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
বুড়িশোল জঙ্গলে যেখানে কিষেণজির মৃত্যু হয়েছে, সেখানে রবিবার দুপুর দেড়টা নাগাদ ডিডিআই (বাঁকুড়া) মানিকলাল কারফা’র নেতৃত্বে সিআইডি-র এক প্রতিনিধি দল পৌঁছয়। ঘটনাস্থল ও আশপাশের এলাকা ঘুরে দেখেন তাঁরা। যেখানে কিষেণজির দেহ পড়েছিল, সেই জায়গাটি খুঁটিয়ে দেখা হয়। পাশের একাধিক গাছে গুলির দাগ রয়েছে। সেই দাগগুলি চিহ্নিত করার পরে ভিডিও ক্যামেরায় ঘটনাস্থল ও সংলগ্ন এলাকার ছবি তোলা হয়।
কয়েকজন গ্রামবাসীর সঙ্গে কথাও বলেন তদন্তকারী অফিসারেরা। সিআইডি সূত্রে খবর, ঘটনার দিন এলাকার পরিস্থিতি কেমন ছিল, গ্রামে ‘বহিরাগত’দের যাতায়াত ছিল কি না, সে সম্পর্কে খোঁজ নেওয়া হয় স্থানীয়দের কাছ থেকে।
জঙ্গলমহলে কিষেণজির শূন্যস্থান ভরাটের জন্য মাওবাদী শীর্ষ নেতৃত্ব যাঁকে দায়িত্ব দিতে পারেন বলে উদ্বিগ্ন গোয়েন্দারা, সেই বেণুগোপাল রাও এই মুহূর্তে ওড়িশা-অন্ধ্রপ্রদেশ সীমানায় সক্রিয় বলে জানতে পেরেছেন তাঁরা। দাদাকে দেখেই ২৬ বছর আগে ঘর ছেড়েছিলেন বেনুগোপাল। জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়েছেন অন্ধ্রপ্রদেশে ও ছত্তীসগঢ়ে। তিন বছর আগে ‘লালগড় আন্দোলন’কে সামনে রেখে মাওবাদীরা যখন জঙ্গলমহলে নিজেদের সংগঠন জোরদার করেছিল, সে সময় বেণুগোপাল ও তেলুগু দীপক ছিলেন কিষেণজির সব সময়ের সঙ্গী। তেলুগু দীপক বর্তমানে জেলে বন্দি। এই অবস্থায় জঙ্গলমহলের দখল রাখতে বেনুগোপালই কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ভরসা বলে মনে করছেন গোয়েন্দারা।
পুলিশকর্তাদের একাংশের বক্তব্য, রাজ্যে পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে জঙ্গলমহলের রাজনৈতিক সমীকরণও যে বদলে গিয়েছে, তা হয়তো ঠিক আঁচ করতে পারেননি মাওবাদী শীর্ষ নেতারা। বুঝতে পারেননি বলেই আগের ‘বিশ্বস্ত’ সৈনিকদের উপরে ভরসা করেছিলেন কিষেণজি। তাঁর দীর্ঘ দিনের অনুপস্থিতিতে স্থানীয় নেতারাও যে জঙ্গলমহলের পরিবর্তিত পরিস্থিতির উপরে পুরোদস্তুর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেননি, তা-ও হয়তো অজানা ছিল ওই মাওবাদী নেতার। বৃহস্পতিবার বুড়িশোলের জঙ্গলে তারই খেসারত তাঁকে দিতে হল বলে মনে করছেন পুলিশকর্তারা।
গোয়েন্দা সূত্রের খবর, বছর দেড়েক আগেও মাওবাদীদের ১৪-১৫টি স্কোয়াড জঙ্গলমহলে ঘোরাঘুরি করত। ‘পিপলস লিবারেশন গেরিলা আর্মি’-র একাধিক প্রশিক্ষণ শিবির চলত। সেখানে স্থানীয় বহু ছেলেকে অস্ত্রশিক্ষা দিয়ে তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল গৃহস্থদের বাড়ি থেকে লুঠ করা একনলা ও দো’নলা বন্দুক। নানা নামে, নানা সহযোগী সংগঠন বানিয়ে ওই ছেলেদের তার সদস্যও করা হয়েছিল। পুলিশ সূত্রের খবর, বিধানসভা নির্বাচনের ক’মাস আগে জঙ্গলমহলের বেশ কিছু ছেলেকে মাওবাদীরা নিয়ে গিয়েছিল ছত্তীসগঢ়ে। সেখানে অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিয়ে ফিরিয়ে আনা হয়েছে জঙ্গলমহলে। তারাই এখন স্কোয়াড সদস্য বলে জানাচ্ছে পুলিশ। এক পুলিশকর্তা বলেন, “স্কোয়াডের ‘চেনা মুখ’ কমে গিয়েছে। উমাকান্ত মাহাতো ও সিধো সোরেনের মতো বেশ কয়েক জন গুলিযুদ্ধে মারা গিয়েছে। ধরা কিংবা আত্মসমর্পণও করেছে অনেকে।” এই পরিস্থিতিতে স্কোয়াডের নতুন মুখগুলোই মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়িয়েছে পুলিশের।
তবে বদলে যাওয়া জঙ্গলমহল আর কিষেণজির মৃত্যুর ধাক্কায় মাওবাদীরাও যে বেশ কোণঠাসা, তা জানিয়ে এক পুলিশকর্তা বলেন, “শীতকালে পাতা ঝরে যাওয়ায় জঙ্গল পাতলা হয়ে যায়। এই সময় সাধারণ ভাবে মাওবাদীরা গ্রামে সংগঠন বাড়ানোর কাজটা করে। কিন্তু জঙ্গলমহল জুড়ে এখন এতই ‘অবিশ্বাস’ যে, এক সময় যে গ্রামগুলো মাওবাদীদের ডেরা ছিল, সেগুলিই এখন বিপজ্জনক বলে ভাবছে তারা।” গোয়েন্দাদের কর্তাদের একাংশ মনে করছেন, কিষেণজির মৃত্যুর পরে সেই ‘অবিশ্বাস’ আরও বাড়বে। আর তারই সুযোগ নেবে যৌথ বাহিনী। |