|
|
|
|
অবহেলায় ধুঁকছে বনপুকুরিয়া ডিয়ারপার্ক |
সমীর দত্ত • মানবাজার |
তিন দশক ধরে পরিকাঠামোর মান বাড়াতে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এর ফলে অবহেলা ও উপেক্ষার শিকার হচ্ছে মানবাজারের বনপুকুরিয়া ডিয়ার পার্ক। এই পার্কের বেহাল অবস্থার কথা মেনে নিয়েছেন দায়িত্বে থাকা বনকর্মীরা।
কাগজে-কলমে বনপুকুরিয়া ডিয়ার পার্ক বাঁকুড়া জেলার রানিবাঁধ থানার অন্তর্গত। মুকুটমণিপুরের কংসাবতী ও কুমারি নদীর বাঁধনে যে জলাধার রয়েছে তার পশ্চিমে জলপথে এক ঘণ্টার পথ অতিক্রম করলে বনপুকুরিয়া ডিয়ার পার্কে পৌঁছনো যায়। কিন্তু স্থানীয় বাসিন্দাদের দৈনিক প্রয়োজন মেটায় কুড়ি কিমি দূরের মানবাজার। মানবাজার পোস্টঅফিস থেকেই ডাক পরিষেবাও নিয়ন্ত্রণ হয়।
কংগ্রেসের সীতারাম মাহাতো বনমন্ত্রী থাকাকালীন বনপুকুরিয়া ডিয়ার পার্ক তৈরি হয়। ৪২ হেক্টর জায়গা নিয়ে কংসাবতী জলাধারের পাশে গড়ে ওঠা ডিয়ারপার্কে হরিণ রাখা শুরু হয় ১৯৮২ সাল থেকে। ৯টি হরিণ দিয়ে শুরু করলেও বর্তমানে হরিণের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৫৫টি। বনকর্মীদের কথায়, হরিণের সংখ্যা কখনও ৭০ ছাড়িয়ে যাওয়ায় এই পার্ক থেকে হরিণ পাঠানো হয়েছে সুতান, জয়পুর প্রভৃতি এলাকায়।
বনপুকুরিয়া লাগোয়া ধগড়া পোস্টঅফিসের কর্মী প্রাণকৃষ্ণ মাঝি বলেন, “বনপুকুরিয়া, গোপালপুর, নারকলি প্রভৃতি গ্রামগুলি বাঁকুড়ার রানিবাঁধ থানার অন্তর্গত হলেও প্রায় তিন দশক ধরে পুরুলিয়ার মানবাজার পোস্টঅফিস থেকে চিঠিপত্র বিলি করা হয়। জরুরি প্রয়োজনেই বাসিন্দারা জলপথ পেরিয়ে রানিবাঁধে যান।” পার্কে গিয়ে দেখা গেল, প্রায় দশফুট উঁচু তারের জাল বেশির ভাগ জায়গায় সংস্কারের অভাবে বড় বড় ছিদ্র তৈরি হয়েছে। কোথাও তার বাধার খুঁটি পড়ে গিয়েছে। বনকর্মীরা জোড়াতালি দেওয়ার চেষ্টা করছেন। দীর্ঘ তিন দশকে হরিণদের জন্য খাবার ও জলের ব্যবস্থা ছিল না। সম্প্রতি পার্কের ভিতরে বাঁধানো জলাশয় নির্মাণ হয়। একটি সাবমার্সিবল পাম্প বসানো হলেও তা থেকে দশ মিনিটের বেশি জল ওঠে না। |
|
ভেঙে পড়ছে ওয়াচ টাওয়ার। নিজস্ব চিত্র। |
বনকর্মী গদাই পালের অভিজ্ঞতা, “গ্রীষ্মে জলাধারের জলস্তর অনেক নীচে নেমে যায় ফলে হরিণরা জলকষ্টে থাকে। এক সময় অন্য জায়গা থেকে জল বয়ে এনে হরিণদের খাইয়েছি। এখন যে সাবমার্সিবল পাম্প আছে তা থেকে পর্যাপ্ত জল মেলে না।” পেশায় গাড়িচালক মানবাজারের বাসিন্দা মনোহর দত্ত বলেন, “বছরে বেশ কয়েক বার ভ্রমণার্থীদের নিয়ে ডিয়ার পার্ক গিয়েছি। সিমেন্টের চাতালে যে পরিমাণ খাবার রাখা থাকে তা পরিমাণে কম বলে মনে হয়েছে। শক্তপোক্ত চেহারার হরিণরা সেই খাবার খেয়ে নেওয়ার পর অপেক্ষাকৃত ছোট এবং দুর্বল হরিণেরা যে ভাবে ওই সিমেন্টের চাতাল চাটতে থাকে। শুধু তাই নয় মাটিতে পড়ে থাকা শুকনো পাতা চিবোতেও দেখেছি।”
কাশীডি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক মানবাজারের বাসিন্দা অমিয় পাত্রের অভিজ্ঞতা প্রায় একই রকম। একাংশ বাসিন্দার অভিযোগ, হরিণদের বংশবৃদ্ধি অনুপাতে ওদের খাবারের বরাদ্দের পরিমাণ বাড়েনি। যদিও বনকর্মী শঙ্কর সিং-এর দাবি, “প্রতিদিন সকাল আটটা ও বিকেল চারটের সময় বরাদ্দ দশ কেজি খাবার দেওয়া হয়। ভেজানো ছোলা, গমের ভুসি ও বিটলবণ মেশানো থাকে।” যদিও বাসিন্দাদের অভিযোগ, বিকেলের পর কোনও কর্মীই এখানে থাকেন না। কয়েক বছর আগে বনে আগুন লেগেছিল। তার আঁচ ছড়িয়েছিল ডিয়ার পার্ক অবধি।
শুধু পার্কের অবস্থা যে খারাপ তা নয়। তিন দশক আগে নির্মিত বনকর্মী ও আধিকারিকদের জন্য বাড়িগুলি সংস্কারের অভাবে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। আগাছার জঙ্গল চারিদিকে। দরজা ও জানলার পাল্লা উইয়ে খেয়ে দিয়েছে। নড়বড়ে ভাঙাচোরা গেট। পার্কের ভিতর ওয়াচ টাওয়ারটি ভেঙে পড়েছে এক দশক আগে। ওটির সংস্কার বা নতুন টাওয়ার নির্মিত হয়নি। মুকুটমণিপুর জলাধার পেরিয়ে যে সব পর্যটক এ পারে আসেন নদীঘাট থেকে ডিয়ার পার্ক অবধি দু’কিমি রাস্তায় পরিবহণের জন্য হাতে গোনা কয়েকটি ভুটভুটি রয়েছে। এবড়ো খেবড়ো রাস্তায় যা বিপজ্জনক ভাবে চলে। নদীঘাটে দু’তিনটি অস্থায়ী চা দোকান রয়েছে। ব্যবসায়ীদের স্বীকারোক্তি, এখানে নলকূপ নেই। তাই জলাধারের জল এনে খেতে হয়।
এতগুলি হরিণ থাকা সত্ত্বেও পাঁচ বছরের বেশি এখানে কোনও বিট অফিসার নেই। আগে স্থায়ী পাঁচ জন বনকর্মী ও বেশ কয়েকজন অস্থায়ী কর্মী থাকতেন। সে পর্ব কবে উঠে গিয়েছে। রানিবাঁধের রেঞ্জার অনাথবন্ধু দাস বলেন, “ওই ডিয়ার পার্কের বেহাল পরিকাঠামোর কথা জানি। বনকর্মী ও বিট অফিসারের অভাব আছে। হরিণের জন্য মাসে ৮০ কেজি ছোলা ও ৪ কুইন্টাল গমের ভূসি বরাদ্দ থাকে। খাবারের টান পড়ার কথা নয়। এ ছাড়াও সবুজ ডালপালা কেটে খাওয়ানোর জন্য দুজন অস্থায়ী কর্মী রয়েছেন। তবু বিষয়টি আমি দেখব। ওয়াচ টাওয়ারের পরিকল্পনা রয়েছে।” তবে বনকর্তার শেষ কথা, “নজরদারি না থাকলে যা হয়!” |
|
|
|
|
|