কলিকাতা কালীর শহর বলিয়া খ্যাত। এই পরিচিতির মূলে যে কালীঘাট মন্দির, ভক্তের নিকট তাহার মহিমা আজও অপার। কিন্তু সেই দেবালয়ে ভক্তেরা সচরাচর যে অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হইয়া থাকেন তাহা অতীব যন্ত্রণাদায়ক। অপরিচ্ছন্ন, কোলাহলমুখর, কলহাক্রান্ত মন্দির এবং মন্দির-চত্বরের এই হালটির পিছনে একটি বড় কারণ পাণ্ডা নামধারী সেবায়েতদের আধিপত্য, যাহা প্রায়শই উপদ্রবে পর্যবসিত হয়। এই পাণ্ডারাই ভক্ত ও ভগবানের মধ্যস্থতাকারী, ভগবানের কাছে পৌঁছাইবার জন্য ভক্তের পাকদণ্ডী। তাই ভগবান অবধি পৌঁছাইতে হইলে পাণ্ডাকে খুশি করা চাই, কেননা মন্দিরের গর্ভগৃহে দেবতার বিগ্রহ স্পর্শ করার সুযোগ উপযুক্ত রজতমুদ্রার বিনিময়ে এই পাণ্ডাই করিয়া দিতে পারেন। ভগবানের সহিত ভক্তের সম্পর্ককে দোকানদারিতে নামাইয়া আনার কৃতিত্ব ভারতের সব তীর্থক্ষেত্রেই মধ্যস্থদেরই। কালীঘাটে এই দখলের বৃত্ত ও পাণ্ডাদের দাপট দূর করিতে কলিকাতা হাইকোর্ট উদ্যোগী হইয়াছে। পুরানো প্রশ্নটি উঠিবেই। কেন এই ধরনের বিষয়ে আদালতকে মাথা ঘামাইতে হয়? উত্তর সুবিদিত স্বাভাবিক নিয়মে শৃঙ্খলা আসে না, তাই।
আদালতের নির্দেশে অতঃপর কেবল সচিত্র পরিচয়পত্রধারী এবং মন্দির কমিটি নিয়ুক্ত পূজারিরাই ভক্তদের গর্ভগৃহে লইয়া যাইতে পারিবেন। কঠোর ভাবে প্রযুক্ত হইলে এবং অক্ষরে-অক্ষরে পালিত হইলে এই নির্দেশ নিঃসন্দেহে শান্তিতে ভক্তদের পূজা-আরাধনার পরিবেশ রচনায় সহায়ক হইবে। মন্দির কমিটি যদি সক্রিয় হয়, তবে মন্দির চত্বর হইতে বাজারের আবহটিও নির্বাসিত হইতে পারে। কমিটিকে বহিরাগতদের দাপট হইতে রক্ষা করিতে পুলিশ মোতায়েনের যে নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে, তাহাও দরকারি বন্দোবস্ত। কিন্তু ইহাই বোধহয় যথেষ্ট নয়। ভক্তদের তরফেও পাণ্ডা-নির্ভরতা হ্রাস করার মানসিকতা থাকা চাই। কষ্ট করিলে তবে কেষ্ট মিলিবে এই প্রবচনের মধ্যে কিন্তু ভক্তের উদ্যোগী ও স্বনির্ভর হওয়ার বিষয়টিও নিহিত। নৈবেদ্য চড়ানো হইতে শুরু করিয়া দৈবানুগ্রহ লাভ পর্যন্ত যাবতীয় কাজের দায়িত্ব পাণ্ডার হস্তে সমর্পণ করিয়া দিলে পাণ্ডারা তাহার সুযোগ লইবেই। দালাল শ্রেণির পরজীবীরা প্রধানত পাণ্ডা-সেবায়েতদের নির্দেশেই মন্দির চত্বরে বিচরণ করে। সেবায়েতদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা এই সমস্যাকে তীব্রতর করিয়া তোলে। এই স্বার্থচক্র ভাঙা শেষ পর্যন্ত সম্ভব হইবে কি না, তাহা নির্ভর করিতেছে ভক্তদের পাণ্ডা-নির্ভরতা রদ হওয়ার উপরেও। একই ভক্ত অন্য দেবালয়ে নিজে যে দেবার্ঘ্য সাজাইতে পারেন, কালীঘাটে গিয়া তিনি পাণ্ডার খোঁজ করিবেন কেন?
বাঙালির অন্য নানা প্রিয় তীর্থস্থানেও পাণ্ডাদের উপদ্রব ভয়ঙ্কর। পুণ্যার্থীদের তীর্থে পৌঁছাইবার অনেক আগে ট্রেন হইতেই পাণ্ডা বা তাহাদের এজেন্টরা ভক্তদের দখল লইয়া ফেলে। পাণ্ডা-পূজারি-সেবায়েতরা কেহ কেহ নিজেরাই বিগ্রহ বা দেবতার অংশ হইয়া ওঠেন, ভক্তজনের চক্ষেও প্রায়শ এমনকী আরাধ্যও হইয়া পড়েন। দৈবানুগ্রহ ভাড়ায় মিলিবার কিংবা মধ্যস্বত্বভোগী মারফত বিতরণ করিবার বন্দোবস্তে দেবতার সহিত ভক্তের সম্পর্কে এ ধরনের বিকৃতি অবশ্যম্ভাবী। আদালত কিংবা অন্য কোনও প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের দ্বারা আদেশ-নির্দেশের কড়াকড়ি করিয়া বাহিরের নৈরাজ্য হয়তো কিছুটা সংস্কার করা সম্ভব। কিন্তু সেই সংস্কার নিছকই প্রসাধনিক হইতে বাধ্য, তাহা মৌলিক বা বুনিয়াদি হইতে পারে না। কেননা ভিতর হইতে শুদ্ধকরণ না ঘটিলে আধ্যাত্মিকতার পরিবর্তে দোকানদারিই ভক্ত-ভগবানের সম্পর্ককে নিয়ন্ত্রণ করিতে থাকিবে। দেবতার মুখোমুখি দাঁড়াইবার আধ্যাত্মিকতা ভক্তকেও অর্জন করিতে হয়। |