ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকার ঠিক কত দূর বিস্তৃত? অভিযুক্তকে জামিন মঞ্জুর করা এবং না-করিবার ভিতরে ঠিক কী পরিমাণ ফারাক? জামিন অগ্রাহ্য করিয়া অভিযুক্তকে কারাগারে রাখিয়া দেওয়া ব্যক্তিস্বাধীনতাকে কত দূর খর্ব করে? সম্প্রতি এই প্রশ্নগুলি উঠিয়া আসিয়াছে। টু জি স্পেকট্রাম মামলায় শীর্ষ আদালতের একটি পর্যবেক্ষণের সূত্রেই এই উত্থাপন। প্রাসঙ্গিক উত্থাপন। শীর্ষ আদালত নিম্ন আদালতগুলিকে স্মরণ করাইয়া দিয়াছে, জামিনের আবেদন অগ্রাহ্য করাই বিধি নহে, বরং ব্যতিক্রম। জামিনে বাহির হইয়া সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি কী কী করিতে পারেন, তাঁহার প্রভাব কত দূর, এই জাতীয় আশঙ্কায় আইন এবং প্রশাসন যদি মামলা চলাকালীন অভিযুক্তকে কারান্তরালে রাখাই সঙ্গত মনে করে, তখন অন্য কয়েকটি প্রশ্নের উদ্ভব হয়। অস্বস্তিকর প্রশ্ন। যিনি জামিনের আবেদন অগ্রাহ্য হইবার কারণে মাসের পর মাস কারাগারে থাকিলেন, তিনি কি আইনের চক্ষে দোষী প্রমাণিত হইবার পূর্বেই এক ধরনের শাস্তি পাইলেন না? আইন বলিতেছে, দোষী প্রমাণিত না-হওয়া পর্যন্ত অভিযুক্তকে অপরাধী হিসাবে গণ্য করা চলে না। সুতরাং, যে কারা-বাস কারাদণ্ড নহে, জামিনের আবেদন অগ্রাহ্য হইবার কারণে কারাগারে দিনযাপন, তাহাকে ব্যক্তিগত স্বাধীনতার বিরোধী বলিয়াই ধরিয়া লওয়া উচিত। দুর্ভাগ্য, বিচার-প্রক্রিয়ার এই মৌলিক সূত্রটি শীর্ষ আদালতকে আরও এক বার স্মরণ করাইতে হইল।
অভিযুক্তকে জামিন মঞ্জুর করিলে মামলায় অবাঞ্ছিত প্রভাব পড়িবার শঙ্কার কথাও অনেক সময় শুনা যায়। শঙ্কাটি অমূলক কি না, তাহা লইয়া বিতর্ক চলিতে পারে। কিন্তু এই জাতীয় আশঙ্কা প্রশাসনিক দক্ষতা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলিয়া দেয়। অভিযুক্ত জামিন পাইলে প্রশাসন যথাযথ ভাবে মামলা সাজাইতে পারিবে না, সুতরাং তাহাকে কারাগারেই আটক রাখা হউক, ইহা কোনও যুক্তি হইতে পারে না। আইন নিঃসন্দেহে তাহার নিজস্ব পথে চলিবে, কিন্তু দোষী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত নিজস্ব ভাবে থাকিবার অধিকার অভিযুক্তেরও আছে। তিনি যদি সেই অধিকারের অপব্যবহার করেন, যদি সেই জাতীয় কোনও অপব্যবহারের ঘটনা প্রমাণিত হয়, তখন উপযুক্ত সাজার বন্দোবস্ত করা যাইতেই পারে। যাহাতে সেই অধিকারের অপব্যবহার না হয়, সেই মর্মে প্রশাসনও উপযুক্ত বন্দোবস্ত গ্রহণ করিতে পারে। অন্যথায়, কেবলমাত্র শঙ্কার বশে ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ধারণাটিকে এমন ভাবে দলিত করা উচিত নহে। সংকট আরও। ভারতে বিচার-প্রক্রিয়া যে হেতু দীর্ঘসূত্রী, তাই অভিযুক্তের কারাগারে থাকিবার মেয়াদও ক্রমে বাড়িতে থাকে। রায় দানে নানা ভাবে বিলম্ব ঘটে। অবাঞ্ছিত বটে, কিন্তু কার্যত অনিবার্য বিলম্ব। বিলম্বিত সুবিচার যে বস্তুত সুবিচার না-পাইবারই তুল্য, তাহা নিছক প্রবাদ নহে, বরং বাস্তব। অতীব তিক্ত একটি বাস্তব। সমস্যা হইল, ভারতের বিভিন্ন মামলার ক্ষেত্রে সেই কাণ্ডটি নিয়মিতই ঘটিয়া চলে। জামিনের আবেদন অগ্রাহ্য করা যে রীতি নহে, বরং তাহাকে ব্যতিক্রম হিসাবেই গণ্য করা উচিত এমন একটি পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে শীর্ষ আদালত সেই জরুরি কথাটিই স্মরণ করাইয়া দিতে চাহিয়াছে। পর্যবেক্ষণটি সময়োচিত সন্দেহ নাই, কিন্তু খটকা লাগে, ইহাও সম্ভবত কিছু বিলম্বিত। টু জি স্পেকট্রাম মামলায় যাঁহারা জামিন পাইলেন, তাঁহারা ইতিমধ্যেই সাত মাস কারাবাস করিয়া ফেলিয়াছেন। এক অর্থে ইহা দণ্ডদানেরই শামিল। আশার কথা, শীর্ষ আদালত স্বয়ং জামিন বিষয়ে মৌলিক প্রশ্ন তুলিয়াছেন। ইহাতে যদি ভারতীয় বিচারবিভাগের মনোভঙ্গি পালটায়। |