জঙ্গলমহলে মাওবাদী শীর্ষ নেতা কিষেণজির ‘পতনে’ উৎসাহিত হয়ে লাগোয়া এলাকাগুলিতেও প্রথম সারির মাওবাদী নেতাদের নিকেশ করে জঙ্গি সংগঠনের কোমর ভেঙে দিতে চায় যৌথ বাহিনী। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের তরফে তাই এখনই ঝাড়খণ্ড এবং ওড়িশায় অভিযান আরও জোরদার করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সিপিআই (মাওবাদী)-এর পলিটব্যুরো সদস্য প্রশান্ত বসু ওরফে কিষাণদা এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মিহির বসু ওরফে অজয়জিও ওই তল্লাটেই গা-ঢাকা দিয়ে আছেন বলে পুলিশি সূত্রের খবর। গত বৃহস্পতিবার বুড়িশোলের কাছে সংঘর্ষের সময় কিষেণজির সঙ্গী সুচিত্রা মাহাতোর খোঁজেও ঝাড়খণ্ডের লাগোয়া এলাকা ধলভূমগড়ে অভিযান চলছে বলে সিআরপি সূত্রে জানা গিয়েছে।
সিআরপি-র এক কর্তার কথায়, “মাওবাদীদের মনোবল চুরমার করতেই শীর্ষ স্তরের নেতাদের জীবিত বা মৃত পাকড়াও করা জরুরি। তাত্ত্বিক নেতা কিষাণদা ছাড়াও আরও জনা পাঁচেক কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ঝাড়খণ্ডে রয়েছে। কিষেণজি নিহত হওয়ার পরে ওরা পাল্টা আঘাত হানার আগেই কিছু একটা করার লক্ষ্যে ঘুঁটি সাজানো চলছে।” তবে শীর্ষ স্তরের নেতারা ছাড়াও ঝাড়খণ্ডে সক্রিয় নাশকতায় তুখোড় এরিয়া কম্যান্ডার স্তরের কয়েক জন জঙ্গি ‘বিপজ্জনক’ বলে মনে করেন পুলিশকর্তারা। তাদের মধ্যে রাঁচির কাছেই বুন্ডু-তামাড়ের এরিয়া কম্যান্ডার কুন্দন পাহন, বোকারোর ঝুমরা পাহাড়ের নবীন মাঝি বা কোয়েল-শঙ্খ জোনাল কমিটির নেতা অনুপ ঠাকুর ওরফে নকুলকে নিয়ে মাথাব্যথা রয়েছে নিরাপত্তা বাহিনীর। রবিবার বুন্ডুর হেসওয়ে গ্রামের কাছে কুন্দন পাহনের স্কোয়াডের সঙ্গে গুলির লড়াই হয় যৌথ বাহিনীর। ওই সময় কুন্দন নিজে লড়াইয়ে হাজির ছিল বলে পুলিশের দাবি। তবে সেই সংঘর্ষে কারও হতাহত হওয়ার খবর মেলেনি।
কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা পশ্চিমবঙ্গের লাগোয়া এলাকা তথা ঝাড়খণ্ডের সক্রিয় ‘উঁচু তলা’র মাওবাদী নেতাদের যে-তালিকা তৈরি করেছেন, তার মধ্যে কিষাণদা ও অজয়জি ছাড়া রয়েছেন একদা সারান্ডায় সক্রিয় লালচন্দ হেমব্রম ওরফে সমরজি, বিহার-সীমানায় পলামুর অজয় গঞ্জু এবং লাতেহারের দেওকুমার সিংহ ওরফে অরবিন্দ। সিআরপি সূত্রের খবর, অজয় ও অরবিন্দও মাওবাদীদের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। তবে ছত্তীসগঢ়ের দন্তেওয়াড়ার পরেই মাওবাদীদের ‘দুর্ভেদ্য’ ঘাঁটি বলে চিহ্নিত সারান্ডায় এখন মাওবাদীরা কোণঠাসা বলেই সিআরপি-র দাবি। সিআরপি-র ডিআইজি (চাইবাসা) ভানুপ্রতাপ সিংহ বলেন, “কিষাণদা বা অজয়জির মতো নেতারাও সারান্ডা থেকে হটে যেতে বাধ্য হয়েছেন। ওঁরা বর্ষীয়ান তাত্ত্বিক নেতা। তবে মাওবাদীদের অন্যতম নীতি-নির্ধারক। তাঁরা ওড়িশার কেওনঝড়ের জঙ্গলে লুকিয়ে আছেন বলেই আমাদের সন্দেহ।”
ঝাড়খণ্ডে রাঁচি, লাতেহার, গুমলা, লোহারদাগার মতো জেলায় সক্রিয় মাওবাদী জঙ্গি কম্যান্ডারদের বিষয়টিও যে যৌথ-বাহিনীর অগ্রাধিকারের মধ্যে পড়ছে, তা মেনে নিচ্ছেন সিআরপি-র ডিআইজি (রাঁচি) বিজেন্দ্রকুমার সিংহ। তিনি বলেন, “কুন্দন পাহন বুন্ডুতে তার নিজের গ্রাম বারিগড়ার আশেপাশে পুরনো ডেরায় জমি দখলের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ওই চেষ্টা করতে গিয়েই সে এ বারেও যৌথ বাহিনীর সঙ্গে টক্করে জড়াল। তবে এ বারেও বাগে পেয়েও ওকে ধরা যায়নি।” গত মে মাসে লোহারদাগায় অভিনব কৌশলে কোডেক্স তারের সাহায্যে বিস্তীর্ণ এলাকায় বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ১১ জন সিআরপি জওয়ানকে হত্যার ‘খলনায়ক’ নকুলকে নিয়েও দুশ্চিন্তায় আছে পুলিশ। গত ৮ নভেম্বর লাতেহারের কোনেয় সিআরপি-র শিবিরে নকুল একই ভাবে নাশকতার ছক কষেছিল বলে পুলিশের দাবি। তবে সে-যাত্রা কিছু যান্ত্রিক গোলযোগে তাদের চেষ্টা সফল হয়নি। হলে লোহারদাগার বিস্ফোরণের থেকেও বড় ক্ষতি হতে পারত।
তবে ঝাড়খণ্ড সরকারের দাবি, লাতেহার-পলামুতে আমজনতার ‘আস্থা’ অনেকটাই অর্জন করতে পেরেছে প্রশাসন। এর ফলে লাতেহারের জঙ্গি অধ্যুষিত এলাকায় কোনে, ওরিয়া এবং সরযূতে যৌথ বাহিনী সহজেই সামরিক শিবির তৈরি করতে পেরেছে, যা মাওবাদীদের বিরুদ্ধে অভিযানে তাদের কৌশলগত ভাবে সাহায্য করছে। ঝাড়খণ্ডের বিভিন্ন জেলায় মাওবাদী দমন অভিযান চলার মধ্যেই এ দিন ওড়িশা-সীমানার সিমডেগায় মাওবাদী ঘাঁটি থেকে দু’টি রাইফেল এবং ২০০ রাউন্ড তাজা কার্তুজ উদ্ধার করা গিয়েছে বলে জানিয়েছেন পুলিশের মুখপাত্র, আইজি রাজকুমার মল্লিক।
|