তাঁর সব সময়ের সঙ্গী, যেটা দিয়ে মুখ ঢেকে সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হতেন, সেই সবুজ গামছটা ছিল না। মুখটা তাই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। শরীরটা মুড়ে দেওয়া হয়েছিল লাল শালুতে। অন্ধ্রপ্রদেশের করিমনগর জেলার পেড্ডাপল্লিতে, বিশাল মাঠে যে চিতা জ্বলে উঠল রবিবার বিকেলে, তাতেই ছাই হয়ে গেল লাল শালু ঢাকা শরীরটা।
শেষ হয়ে গেল মাল্লোজুলা কোটেশ্বর রাও ওরফে কিষেণজির অধ্যায়।
সারা জীবন যে জনগণকে সামনে রেখে লড়াইয়ের দাবি করতেন, যে সংবাদমাধ্যম তাঁর জন্য হন্যে হয়ে থাকত, যে পুলিশের তিনি রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিলেন অন্তিম লগ্নে তারাই ঘিরে রাখল কিষেণজিকে। মাওবাদী নেতা হিসেবে নয়, পৃথক তেলেঙ্গানার দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলার জন্যই কিষেণজিকে মনে রাখতে চায় পেড্ডাপল্লির জনতা (কিষেণজির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এসে মাওবাদী-ঘনিষ্ট সংস্কৃতিকর্মী গদরও জানালেন, এ বার গতি পাবে তেলেঙ্গানা আন্দোলন)। জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেস-কাণ্ডে ১৪৮ জন নিরীহ মানুষের মৃত্যুর পিছনে কারা, তা ওই জনতার জানা নেই। যেমন জানা নেই, গত কয়েক বছরে পশ্চিমবঙ্গে মাওবাদী-হানায় নিহত হয়েছেন বহু মানুষ। আর ওই সব কাণ্ডের জন্য পুলিশের খাতায় মূল অভিযুক্ত পেড্ডাপল্লির কোটেশ্বর রাও। জানা তো নেই-ই, কথাবার্তা স্পষ্ট জানার দায়ও নেই। স্থানীয় সাংবাদিকরাই বললেন, “এখানকার মানুষ ওঁকে জাতীয় নায়কের মর্যাদা দেয়। পশ্চিমবঙ্গে ওঁর বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই।” উল্টে পরিবারের পক্ষ থেকে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিরুদ্ধে কিষেণজিকে খুনের অভিযোগ এনে কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির কাছে ই-মেল পাঠানো হয়েছে। রবিবার কিষেণজির মরদেহে মালা দেওয়ার পরে এ কথা জানালেন মাওবাদী-ঘনিষ্ঠ তেলুগু কবি ভারভারা রাও।
|
শনিবার রাত দেড়টা নাগাদ পেড্ডাপল্লির বাড়িতে কোটেশ্বরের দেহ পৌঁছে দেয় পুলিশ। কাঠের কফিন থেকে তা বার করে রাখা হয় কাচের চৌকো বাক্সে। যার তলায় ঠান্ডা-যন্ত্র। ডান দিকের চোখের জায়গাটা খালি। নীচের চোয়ালের বেশির ভাগটাই উড়ে গিয়েছে। মাথার ডান দিকে আঘাতের চিহ্ন। শুধু সামনের দাঁতের উঁচু পাটি থেকেই চেনা যাচ্ছে। ভারভারার অভিযোগ, “গুলিতে তিনি মরেননি। বেয়নেটে খুঁচিয়ে মারা হয়েছে। ডান চোখ উপড়ে নেওয়া হয়েছে। ইলেকট্রিক হিটারের উপরে দেহ ফেলে অত্যাচার করা হয়েছে। তাই পা দু’টো কালো হয়ে গিয়েছে। বাঁ পায়ের তলার দিক কেটে বাদও দিতে হয়েছে।”
সকাল থেকেই সর্পিল লাইন বাড়ি ছাড়িয়ে বহু দূর চলে গিয়েছিল। কারা এরা? স্থানীয় থানার ইন্সপেক্টর কিরণ কুমারের কথায়, “৭০ শতাংশই স্থানীয় লোক। বাকিরা বাইরে থেকে এসেছেন। কয়েক জন রাজনৈতিক নেতাও আছেন।” তাঁদেরই এক জন বছর পঁয়ত্রিশের তিরুমল। এফসিআই কর্মী। কী জানেন কিষেণজি-র বিষয়ে? লাজুক হেসে বললেন, “কিছুই না! রবিবার ছুটির দিনে পড়শিরা আসছে দেখে আমিও এসেছি।” বেঙ্কটেশ্বম পক্ককেশ বৃদ্ধ। তাঁর দাবি, “ছোটবেলায় কোটেশ্বর স্কুলে পড়ার সময়ে ওঁকে দেখেছি। এখন এত নাম-ডাক। তাই চলে এলাম।” আদতে সব থেকে বেশি উৎসাহ, তেলেঙ্গানা রাষ্ট্র সমিতির (টিআরএস)। অন্ধ্রপ্রদেশের উত্তরের ১০টি জেলা নিয়ে পৃথক রাজ্যের দাবিতে তাদের আন্দোলনের গোড়ার পর্বে ছিলেন কিষেণজি। তিরুমলের দাবি, “কিষেণজির মৃত্যুকে আন্দোলনের হাতিয়ার হিসেবে কাজে লাগাতে চাইছেন তেলেঙ্গানা আন্দোলনের নেতারা। যেন তিনি ওই আন্দোলনেরই শহিদ।”
গদরও বক্তৃতা দিয়েছেন কিষেণজির দেহের সামনে।
তেলুগু ভাষার সেই বক্তৃতা থেকে ছিটকে এসেছে, ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল গভর্নমেন্ট’, ‘মমতা ব্যানার্জি’, ‘এনকাউন্টার’-এর মতো কয়েকটা শব্দ। কলকাতা থেকে আসা সাংবাদিককে পেয়ে গদর বললেন, “আপনারা কিষেণজিকে চেনেন মাওবাদী নেতা হিসেবে। আমরা চিনি তেলেঙ্গানা আন্দোলনের জনক হিসেবে। ২০০৯ সালে যখন নতুন করে তেলেঙ্গানার দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়, গভীর জঙ্গল থেকে তিনি জনে-জনে ফোন করে বলতেন, লড়াই ছাড়া আপস করো না। আমার সঙ্গেও ফোনে কথা হয়েছিল।”
জনতার পাশাপাশি খাকি ও সাদা পোশাকের পুলিশও ছিল চোখে পড়ার মতো। কোমরে গোঁজা গ্লক, নাইন এমএম, কাঁধে একে-৪৭ ও একে-৫৬। এত পুলিশ কেন? ইনস্পেক্টর কিরণ কুমার বললেন, “নেতাকে শেষ দেখা দেখতে যদি কোনও মাওবাদী জঙ্গি চলে আসে! স্পটাররাও ঘুরছে। সন্দেহজনক কাউকে দেখলেই চিনিয়ে দেবে।”
‘নাটক’-ও আছে বিস্তর। হায়দরাবাদ বিমানবন্দর থেকে কিষেণজির দেহ নিয়ে বেরোলেই সংবাদমাধ্যম তাড়া করতে পারে, এ কথা ভেবে পুলিশ নয়া ফন্দি এঁটেছিল। একই সঙ্গে চারটে অ্যাম্বুল্যান্স নিয়ে আলাদা-আলাদা কনভয় বেরোয়। কিষেণজির দেহ নিয়ে আসল কনভয়টি ঘুর পথে দেড় ঘণ্টা দেরিতে পেড্ডাপল্লি পৌঁছয়। তাতে অবশ্য শেষ রক্ষা হয়নি। স্থানীয় সাংবাদিক মধুকরের কথায়, “ওই কনভয়ের পিছনেও সেঁটেছিল মিডিয়া।” প্রথমে ঠিক হয়, পেড্ডাপল্লির কলেজ মাঠে দেহ শায়িত থাকবে। কিষেণজির দাদা অঞ্জনেপিউলু জানালেন, প্রথমে অনুমতি দিলেও পরে সিদ্ধান্ত পাল্টায় পুলিশ। অগত্যা দেহ রাখা হয় বাড়িতেই। রবিবার সকালে পেড্ডাপল্লি আসার পথে কড়া প্রহরায় ভিড় বিশেষ বাড়তে দেয়নি পুলিশ।
পেড্ডাপল্লির বাড়িতে ভিড়ের মধ্যে এ দিনও দেখা গিয়েছে জগন্মোহন সিংহকে। কিষেণজি-র ছোটবেলার বন্ধু, অনুগামী। তেলেঙ্গানা ও মাওবাদী-আন্দোলনের সঙ্গী। সকাল থেকেই জনতাকে ফুল সরবরাহ করছিলেন। বিকেলে সেই জগনকেই দেখা গেল, একা-একা প্রিয় বন্ধুর চিতায় কেরোসিন ছিটিয়ে চলেছেন। কাছে যেতে চোখ মুছে বললেন, “জানেন, ও বলত, কমিউনিস্ট হওয়াটা বড় কথা নয়। কমিউনিস্ট জীবনচর্যাটাই বড় কথা। আর কমিউনিস্ট হিসেবে মৃত্যু আরও বড়।” গলা বুজে এল তাঁর।
|