লোকসভা উপনির্বাচনের আগে শেষ রবিবারে প্রচারের ময়দানে দেখা গেল দুই যুযুধান শিবিরের দুই সেনাপতিকে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর পূর্বসূরি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য!
প্রথম জন বরাবরের মতোই অনর্গল। দ্বিতীয় জন দু’মাস আগের ভবানীপুর বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনের প্রচারের মতোই নীরব! তবে দু’জনেই প্রচারের শেষ লগ্নে বেছে নিয়েছিলেন দক্ষিণ শহরতলির বেহালাকে। দক্ষিণ কলকাতা লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত যে এলাকা একেবারেই তৃণমূলের ‘খাসতালুক’। বেহালার দুই কেন্দ্রের একটি থেকে বিধায়ক কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়। দেড় বছর আগে তাঁর মেয়র হওয়ার পুরভোটে বেহালার সব ওয়ার্ডে ধূলিসাৎ হয়েছে সিপিএম। পাশের কেন্দ্রের বিধায়ক শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। ৬ মাস আগে যিনি বিধানসভায় সর্বোচ্চ ব্যবধানে (দার্জিলিং বাদ দিয়ে) জিতেছেন।
এ হেন বেহালায় মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রী মমতার জনসভা ঘিরে উদ্দীপনা সেই অর্থে অভিনব নয়। কিন্তু অজন্তা সিনেমা থেকে ঠাকুরপুকুর ৩এ বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত বুদ্ধবাবুর জিপযাত্রা এবং মিছিলে ভিড় বেহালার রাজনৈতিক সমীকরণ মাথায় রেখেই ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ বলে মনে করছে সিপিএম। দক্ষিণ কলকাতার বিভিন্ন এলাকা থেকেই সিপিএম কর্মী-সমর্থকেরা মিছিলে যোগ দেন। তাঁদের মধ্যে মহিলা এবং তরুণদের সংখ্যা ছিল চোখে পড়ার মতো। দক্ষিণ কলকাতায় সিপিএম প্রার্থী ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় দলের ছাত্র সংগঠন এসএফআইয়ের সাধারণ সম্পাদক। স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর সমর্থনে শেষ ছুটির দিনের প্রচারে সামিল হয়েছিলেন প্রচুর ছাত্রছাত্রী। ডায়মন্ড হারবার রোডের দু’পাশে বেহালা থানা, অশোকা সিনেমার মোড়, ম্যান্টন, চৌরাস্তা, বড়িশা, শখের বাজারের মতো বাজার-এলাকায় রাস্তার ধারে বহু মানুষ ভিড় করেছিলেন।
|
সিপিএমের ওই মিছিলের কথা সম্ভবত কানে গিয়ে থাকবে মুখ্যমন্ত্রীর। তার অব্যবহিত পরেই বেহালা চৌরাস্তায় তৃণমূল প্রার্থী সুব্রত বক্সীর সমর্থনে জনসভায় মমতা তাই বুদ্ধবাবুর মিছিলের প্রতি তির্যক কটাক্ষে বলেন, “রাস্তায় মিটিং-মিছিল করবেন না। রাস্তায় গাড়ি থাকে। যানজট হয়ে যায়। মানুষের অসুবিধা হয়! বড় বড় রাস্তায় বছরে একটা-দু’টো মিছিল হতে পারে। মানুষকে কষ্ট দিয়ে কোনও রাজনৈতিক দলের কিছু করা উচিত নয়। এই জন্যই বন্ধ-অবরোধ বন্ধ করেছি।” মেয়র শোভনকে দেখিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “ও বলেছিল, বেহালায় কেন্দ্রীয় মিছিল করতে। আমি এই কারণেই রাজি হইনি।” প্রসঙ্গত, মুখ্যমন্ত্রী যে সভায় দাঁড়িয়ে এই কথা বলছিলেন, তার মঞ্চ হয়েছিল ডায়মন্ড হারবার রোডে এক দিকের রাস্তা জুড়েই। এবং তার জন্য সাময়িক ভাবে যানবাহন ঘুরিয়েও দেওয়া হয়েছিল।
চৌরাস্তায় মমতার জন্য বাঁধা সভামঞ্চের পাশ দিয়ে মিছিল নিয়ে গিয়েছিলেন বুদ্ধবাবু। মঞ্চে উপস্থিত জনাকয়েক তৃণমূল কর্মী প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশে হাত জোড়ও করেছিলেন। বুদ্ধবাবু অবশ্য সে দিকে ফিরে তাকাননি!
হুডখোলা জিপে প্রার্থী ঋতব্রত এবং দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য রবীন দেবকে নিয়ে রোড-শো শুরু করেছিলেন বুদ্ধবাবু। জিপের চালক সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য সীতারাম ইয়েচুরির দীর্ঘদিনের ‘আস্থাভাজন’ সোহন সিংহ। ঘটনাচক্রে, ইয়েচুরিও এ দিন একবালপুর এবং বালিগঞ্জে প্রচার-সভা করেছেন। বুদ্ধবাবুর পিছনে আর একটি খোলা জিপে ছিলেন নন্দিনী মুখোপাধ্যায়, পার্থপ্রতিম বিশ্বাস, ফুয়াদ হালিম, প্রাক্তন বিধায়ক কুমকুম চক্রবর্তী। সাম্প্রতিক কালে যাঁরা দক্ষিণ কলকাতার বিভিন্ন কেন্দ্রে সিপিএমের হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন এবং হেরেছেন। ছিলেন প্রাক্তন মন্ত্রী শ্রীকুমার মুখোপাধ্যায়ও। রাস্তায় হাজির জনতার দিকে হাত নেড়ে এবং হাত জোড় করে ঋতব্রতের জন্য ভোট চেয়েছেন। তবে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী নীরব থাকলেও মিছিল ছিল সরব। সেখানে মূল্যবৃদ্ধির প্রশ্নে ইউপিএ-২ সরকারের বিরুদ্ধে যেমন আওয়াজ উঠেছে, তেমনই রাজ্যের ক্ষেত্রে উঠে এসেছে পরিবহণ কর্মীদের বেতন ও পেনশন সংক্রান্ত সমস্যার কথা। কারণ, ওই কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী সুব্রতবাবুই রাজ্যের পরিবহণমন্ত্রী।
|
যে সুব্রতবাবুর সমর্থনে রাতের সভায় মমতা সিপিএমের উদ্দেশে বলেন, “আজ যাঁরা ভোট চাইছেন, তাঁদের যদি বলি, এক টাকার মধ্যে ৯৪ পয়সায় সরকার চালাতে পারতেন? এই পরিস্থিতির মধ্যে গত ৬ মাস যা কাজ করেছি, গত ৩৬ বছর (আসলে ৩৪) ওরা তা করতে পারেনি! কারও
দয়ায় ক্ষমতায় আসিনি! কারও দয়ায় থাকবও না!” পার্থবাবু বলেন, “সিপিএম এত দিন পরে বালিশের তলায় ভাঁজ করা পতাকা নিয়ে বেরিয়েছে! হয়তো চিমটি কেটে দেখছে, ক্ষমতায় আছে কি না! ক্ষমতা থেকে কেন চলে গেলাম, সেই মর্মবেদনা নিয়েই
ওরা ঘুরছে!”
সুব্রতবাবু এ দিন তাঁর নিবার্চনী কেন্দ্রের মারোয়াড়ি, শিখ ও গুজরাতি সম্প্রদায়ের বাসিন্দাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বিকেলে হাজরা পার্ক থেকে তাঁর সমর্থনে মিছিল করে ‘অল ইন্ডিয়া তৃণমূল যুবা’। সুব্রতবাবু সেই মিছিলে ছিলেন। পরে খিদিরপুর ও মনোহরপুকুরে দু’টি সভায় বক্তা ছিলেন। তাঁর ‘নিজের লোক’ বলেই এই সুব্রতবাবুকে দক্ষিণ কলকাতায় এগিয়ে দিয়েছেন মমতা। আর সেই পরিচয়কেই কটাক্ষ করে একবালপুরের সভায় সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য মহম্মদ সেলিম বলেছেন, “বিষ্ণুপুর, চৌরঙ্গি, ভবানীপুরের বিধায়ক থেকে এ বার দক্ষিণ কলকাতায় সাংসদ হওয়ার জন্য এসেছেন, তাঁর দলনেত্রী বলছেন, বক্সীর সঙ্গে ‘বোঝাপড়া’ আছে। দরকার হলে ওঁর জন্য দক্ষিণ কলকাতা আবার ছেড়ে দেবেন! এটা কি কেরোসিন তেলের লাইনে ইট পেতে জায়গা রাখা হচ্ছে? গণতন্ত্র একেই বলে?”
|