|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ১... |
|
পুরুষ নেতারা শক্ত হাতে চালনা করতেন |
ভাস্বতী চক্রবর্তী |
আইডেন্টিটিজ অ্যান্ড হিস্টরিজ: উইমেনস রাইটিং অ্যান্ড পলিটিকস ইন বেঙ্গল, শর্মিষ্ঠা দত্ত গুপ্ত। স্ত্রী, ৭০০.০০ |
ষাটের দশকে প্রকাশিত স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলার নারী বইটিতে কমলা দাশগুপ্ত রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন সম্পর্কে বলছেন: ‘...তিনি...অবরোধবাসিনী মহিলাদের যে বেদনাতুর চিত্র তুলে ধরেছেন তা সমাজ-ব্যবস্থার মূলে কুঠারাঘাত হানবার জন্য প্রেরণা জাগিয়েছে। এদিক থেকে তিনি বিপ্লবী। প্রত্যক্ষ ভাবে তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগদান না করলেও অনগ্রসর সমাজের নারীদের মধ্যে দেশানুরাগ জাগাবার যে প্রচেষ্টা তিনি সারাজীবন ধরে করে গেছেন তার মূল্য কম নয়।’ কমলা দাশগুপ্ত মন খুলেই রোকেয়াকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করছেন। তা সত্ত্বেও হয়তো লেখকের অগোচরেই বাক্যগুলি যেন অদৃশ্য বাধায় অল্প অল্প হোঁচট খাচ্ছে, যেন শব্দের ভেতর থেকে উঁকি-দেওয়া ইতিহাস তাদের পা আটকে ধরছে।
যেমন, যে নারী মেয়েদের শিক্ষা প্রসারের কাজে জীবন উৎসর্গ করলেন, ধর্মতন্ত্রের বিরুদ্ধে বহু দিন সোচ্চার হলেন, যে নারীর সাংগঠনিক শক্তি ও অক্লান্ত ক্ষুরধার কলম, তাঁর স্বদেশকে স্বাধীন করার স্বপ্ন ও সকলের মধ্যে তা ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা সত্ত্বেও তিনি কিন্তু ‘এ দিক থেকে’ বিপ্লবী। কমলা দাশগুপ্ত যখন ১৯৩৮-এ ‘মন্দিরা’ পত্রিকায় সম্পাদকের কাজ শুরু করেন, তখন রাজনৈতিক বিপ্লবীর পরিচয় সম্বন্ধে তাঁর ধারণা একেবারে চাঁছাছোলা। তাই ষাটের দশকে লেখা বইতেও ‘বিপ্লবী’ শব্দটি যেন দু’ভাগে ভাগ হয়ে যাচ্ছে রোকেয়ার বৈপ্লবিক ব্যক্তিত্ব ও জীবনব্যাপী বিশাল কর্মযজ্ঞের সঙ্গে ‘প্রত্যক্ষ’ রাজনীতির সম্পর্ক করা যাচ্ছে না। ‘দেশানুরাগ’ জাগিয়েই তাঁর রাজনীতির ইতি, তাঁর ‘কুঠারাঘাত’ ‘সমাজ ব্যবস্থার মূলে’ অতএব কেবল ‘এ দিক’ দিয়েই তিনি বিপ্লবী।
বিশ্লেষণ করলে আরও জটিলতা পাওয়া যাবে। কিন্তু রাজনীতি ও সমাজের এই বিভাজন থেকেই শুরু করা যাক, এরও অনেক রূপ আছে। দেশভাগের রাজনীতির ফলে অসহায় মেয়েদের জন্য সারা জীবন কাজ করেও বহু মহিলা মনে করতেন তাঁরা সমাজের কাজ করেছেন, রাজনীতির সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক নেই। মেয়েদের পরিচয় গঠনে এ রকম বহুবিধ জটিলতার সূত্র শর্মিষ্ঠা দত্ত গুপ্তের চর্চার বিষয়। ইংরেজ রাজত্বের শেষ বেলায় এবং স্বাধীনতার ঠিক পরে প্রকাশিত মুখ্যত মেয়েদের প্রবন্ধ-সাহিত্যের খেই ধরে তিনি আলোচ্য বইটিতে জাগরণপ্রয়াসী মুক্তিকামী নারীর নিজেদের ও পরস্পরের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁদের আত্মবীক্ষণে স্ব স্ব সামাজিক পটভূমি, জাত, ধর্ম এবং সমসাময়িক চিন্তার আবহ কী ভাবে বিধৃত হত? মেয়েদের মাতৃ-রূপ ও গৃহলক্ষ্মী-রূপ ঘরের বাইরের জগতে নারীর ভূমিকা ও কর্তব্যের ধারণাকে কী ভাবে প্রভাবিত করত? ধারণাগত ঝোঁক যে দিকেই পড়ুক, মেয়েরা তার মধ্যে প্রত্যক্ষ ভাবে রাজনীতি করছেন, জেলে যাচ্ছেন, লেখালেখি করছেন, ঘরও করছেন, পত্র-পত্রিকাও চালাচ্ছেন এবং এ সবের মধ্য দিয়ে অন্যের প্রতি, নিজেদের প্রতি এবং কাজ ও কাজের লক্ষ্যের প্রতি তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাচ্ছে।
খেলনার কৌটোর মধ্যে কৌটোর মতো শর্মিষ্ঠা প্রশ্নের পর প্রশ্ন খুলে ধরেন ভূমিকাতে। দু’টি প্রশ্ন তাঁর গবেষণার মূলে গিয়ে পৌঁছয়: প্রাতিষ্ঠানিক বিন্যাসে, মানে সাময়িকপত্রে, সমাজকল্যাণমূলক অধিষ্ঠানে এবং রাজনৈতিক সংগঠনে লিঙ্গভেদের কী ভূমিকা ছিল? পুরুষ ও নারীর আলাদা কাজের এবং ক্ষমতার-- ক্ষেত্র নির্ণয় করে সেগুলিকে ধরে রাখার প্রচেষ্টা যে ছিল সেটা স্পষ্ট। তার সঙ্গে তাঁদের বুদ্ধি ব্যবহারের পথ ও চিন্তার উপযুক্ত বিষয় ভিন্ন করে রাখায় প্রতিষ্ঠানগুলির কী অবদান ছিল? লিঙ্গভেদ ও রাজনীতি পরস্পরকে কী ভাবে প্রভাবিত করে তার ইতিহাসের খোঁজে শর্মিষ্ঠা বেছেছেন একটি দৈনিক সহ ছয়টি সাময়িকপত্র। তাঁর বইয়ের অধ্যায়গুলি সাময়িকপত্র অনুযায়ী বিন্যস্ত। ‘প্রবাসী’ ১৯০১ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর প্রকাশিত হয়েছিল, তার বেশির ভাগ সময়ে সম্পাদক ছিলেন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। তিনি নারী-পুরুষের সাম্যে বিশ্বাস করতেন। ‘প্রবাসী’-তে যে শুধু মেয়েদের শিক্ষা ও ঘরে-বাইরে তাঁদের ভূমিকা আলোচিত হত তা-ই নয়, ‘প্রবাসী’-তে অনেক মহিলা নিজেরা এ বিষয়ে লিখতেন। তবে শিক্ষিত উচ্চ ও মধ্যবিত্ত সমাজ-ই উদারনৈতিক সংস্কারমনস্কতার লালনভূমি। তার ফলে স্ত্রী-পুরুষের সমানাধিকারের স্বীকৃতি দিয়েও মেয়েদের রাজনীতির চেয়ে সমাজকল্যাণের দিকে ঠেলে দেওয়ার প্রতি ‘প্রবাসী’র ঝোঁক ছিল।
মধ্যবিত্ত বাঙালি মুসলমান মেয়েদের নিজেদের পরিচয় গঠন করার ক্ষেত্র বিশেষ করে খুলে দিয়েছিল ‘সাওগাত’। ১৯১৮ থেকে প্রকাশিত এই পত্রিকার যুদ্ধ ছিল ‘প্রবাসী’র সংস্কারকামী অভিযানের চেয়ে অনেক কঠিন নারীশিক্ষার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে অবরোধ ঘোচানোর প্রয়োজনীয়তা বোঝানো থেকে তার শুরু। এতে মেয়েরা গোড়ায় লিখতেন, বছর দুয়েক বাদে তাঁদের লেখা ‘মহিলা সাওগাত’ নামে বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত হতে থাকে, শেষে তা ‘বেগম’ নামে আলাদা পত্রিকায় চলে যায়। যে ভিন্নতা ভাঙতে ‘সাওগাত’ যুদ্ধে নেমেছিল, মেয়েদের শিক্ষার উন্নতি ও চিন্তাশীল লেখা বৃদ্ধি পাওয়ায় আবার সেই ভিন্নতাই ফিরে এল।
‘জয়শ্রী’ (১৯৩১), ‘মন্দিরা’ (১৯৩৮) এবং ‘ঘরে বাইরে’ (১৯৪৮) ছিল তিনটি নারী সংগঠনের প্রকাশনা। ‘জয়শ্রী’র সম্পাদক দীপালী সংঘের লীলা রায় মনে করতেন না যে, রাজনীতিতে যোগদান করার কারণ এবং রাজনৈতিক কাজ স্ত্রী ও পুরুষের আলাদা হওয়া উচিত। মেয়েরা যে সময়ে প্রত্যক্ষ ভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে সে সময়ে পুরোপুরি মেয়েদের প্রকাশ করা পত্রিকায় সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও শিক্ষাগত ক্ষেত্রে নারীর অবস্থা নিয়ে নিজেদের আলোচনা করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করে ‘জয়শ্রী’ শুরু হয়। অথচ দেশীয় রাজনীতির গতিপথের অংশীদার হয়ে ‘জয়শ্রী’ কয়েক বছর পরে বিশেষ দলমতাবলম্বী হয়ে ওঠে ও তার সঙ্গে পুরুষদের প্রবন্ধও নিতে শুরু করে। এ যেন প্রায় ‘সাওগাত’-এর উল্টোমুখী পথে হেঁটে নারীর স্বাধীন বৌদ্ধিক ক্ষেত্র সৃষ্টি করার লক্ষ্য থেকে ‘জয়শ্রী’ ছিটকে পড়ে।
রাজনৈতিক সংগঠনে মেয়েদের উপস্থিতি বাড়তে থাকলেও তাঁদের মতামত ও আদর্শগত প্রভাব যে পুরুষ নেতারা ‘দাদারা’ শক্ত হাতে চালনা করতেন, তার উদাহরণ ‘মন্দিরা’। কিছুকাল পর বাংলার কমিউনিস্ট আন্দোলনের মহিলা কর্মীরা ‘ঘরে বাইরে’ বার করতে শুরু করেন। সে সময়ে দৈনিক ‘স্বাধীনতা’-র সঙ্গে ‘ঘরে বাইরে’ শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজের বাইরের মেয়েদের রাজনৈতিক ও সামাজিক উন্নতির বৃত্তে টেনে আনার প্রয়াস করেছিল। এ ক্ষেত্রেও দলীয় রাজনীতি ও নারী স্বাধীনতার পথ ক্রমশ আলাদা হতে থাকে, কাগজগুলিরও আয়ু ফুরিয়ে আসে।
শর্মিষ্ঠার ঘননিবদ্ধ ও একই সঙ্গে বিস্তৃত অনুসন্ধানের এটি অত্যন্ত মোটা দাগের বিবরণ। নারী স্বাধীনতার ইতিহাসে মেয়েদের পরিচয়ের বিভিন্ন দিক ও দিক বদল, দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও পরিবর্তনশীল রাজনীতির সঙ্গে পরিচয় গঠনের সংযোগ, এবং মেয়েদের লেখায় তার সূক্ষ্ম জটিল প্রকাশ শর্মিষ্ঠার মুখ্য বিষয়। কিন্তু এর সঙ্গে সমসাময়িক ইতিহাস, বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলনের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ, নারী জাগরণে বহু নারীর এবং পুরুষের অবদান এবং তাতে সাময়িকপত্রের ভূমিকা, তাঁদের আদর্শ, মতামত, যুক্তি, বক্তব্য, তাঁদের দ্বিধা ও স্ববিরোধ সবই শর্মিষ্ঠা নিপুণ ভাবে গ্রথিত করেছেন। বইয়ের শেষে পরিচিতি, টীকা ও নির্দেশিকা অত্যন্ত মূল্যবান।
তবে, কোনও কোনও জায়গায় সম্পাদনার দিকে আরেকটু মনোযোগ দিলে আরও ভাল হত; কয়েকটি সাধারণ ব্যাকরণগত ভুল ঠিক করে নেওয়াই যেত। ইংরেজি ভাষায় লেখা বলে অনেক বেশি সংখ্যক পাঠকের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠবে ভারত ও বাংলার তোলপাড় করা সময়ে মেয়েদের চেতনা গঠনের নানা স্তর। কিন্তু একটি বাংলা সংস্করণ ঠিক অনুবাদ নয় হলেও বেশ ভাল হয়। বইটির বহুমুখী তাৎপর্য হয়তো এতে আরও সার্থকতা পাবে। |
|
|
|
|
|