শনিবারের নিবন্ধ
বিয়ে পাশ করতে হলে
বিয়ের জন্য টিউলিপ আসছে ইউরোপ থেকে। সেই সব ফুলের রং অপছন্দ হলে রাসায়নিকের সাহায্যে পছন্দ মতো রংও করে নেওয়া হচ্ছে! প্রাক-বিবাহ অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রিতদের প্রত্যেককে উপহার। রিসেপশনের দিন বলিউডের সেলিব্রিটিদের নাচাগানা।
এই সব কিছুই হচ্ছে আজকাল বাঙালির ছাঁদনাতলাতেও। এখন বিয়ে মানে আর পরিবারের লোকজন নিয়ে আনন্দে মাতা নয়। বিয়ে মানে একটা বিরাট পার্টি। ঝাঁ-চকচকে বৈভবের মনোরঞ্জন চ্যানেল। খরচা কোটির পারদ ছাড়ালেও। আজ্ঞে হ্যাঁ, বাঙালি বিয়েতেও! বিয়ের আসরকে স্টার মার্কস নিয়ে পাশ করাতে হবে তো।

স্রেফ কার্ড নয় লোগোও চাই
বাঙালি থিম বিয়েতে কার্ড দিয়েই থিমের শুরু হচ্ছে। যেখানে কু্ষ্ঠি মেলানোটা হালফিলের ট্রেন্ড। কুষ্ঠি, হবু কনে বা বরের সই, বাস্তু এবং রং মিলিয়ে বিয়ের কার্ডের অর্ডার যাচ্ছে। এমনকী প্রাক-বিবাহ কার্ডের চল হয়েছে। “কিছু দিন আগে এক জন নামী শিল্পপতির মেয়ের বিয়েতে অতিথি পিছু ১২টি করে প্রাক-বিবাহ কার্ড বানিয়েছিলাম। বিয়ের এক বছর আগে থেকে প্রত্যেক মাসে একটি করে এই স্পেশ্যাল কার্ড যেত আত্মীয়স্বজনের বাড়ি,” বলছেন শ্রেয়াংশ বৈদ্য। শ্রেয়াংশের সংস্থার ব্যবসাই হল, আবদার মতো বিয়ের কার্ডের ব্যবস্থা করা। কনের পোশাক বা শাড়ির রংয়ের সঙ্গে মিলিয়েও হচ্ছে কার্ডের ডিজাইন। শ্রেয়াংশের সংস্থা সোনার সুতোর কারুকার্য করা কার্ডও বানিয়েছেন। বিয়ের বিশেষ ‘লোগো’ও তৈরি করেন তাঁরা। মানে বিয়ের ব্র্যান্ডিং? “নয় কেন? থিম আলাদা হলে সেটাকে ব্র্যান্ডিং করা হবে না কেন?” শ্রেয়াংশের বক্তব্য। এক বাঙালি পাত্র নাকি তাঁর বিয়ের লোগো হাতে পায়ে ট্যাটুও করেছিলেন, জানাচ্ছেন তিনি।
খরচ:

তখন যেমন হত

থিমই আসল
ফুল বা প্যান্ডেলের কুচি? সে সব তো মান্ধাতার আমলের কথা! এখন থিমের জমানা। টলিউডের হিরো জিতের বিয়ের কথাই ধরুন না। জিতের বিয়ে ‘ম্যানেজ’ করেছিলেন গীতেশ অগ্রবাল। সেই গীতেশ বলছেন, “বাঙালিদের মধ্যে যেমন অবাঙালিয়ানা ঢুকছে, ঠিক তেমনই অবাঙালিদের মধ্যেও বাঙালি থিম জনপ্রিয় হচ্ছে। জিতের ‘রিসেপশন’-এর দিন যেমন ছিল বাঙালি থিম।” তবে খাঁটি বাঙালি সাজ তুলনামূলক ভাবে সস্তা পড়ে। সেখানে অন্য থিমের জন্য খরচ কম করে চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা।”
তবে বাঙালিদের মন আজকাল আর শুধু বাংলা থিমে ভরছে না। দেখনদারির পরীক্ষায় পাশের তাগিদ চাইছে অন্য কিছু। ইভেন্ট ম্যানেজার বিনোদ ভাণ্ডারি জানালেন, “চেনা এক বাঙালি ডাক্তারের প্রবাসী ছেলের বিয়ে ছিল। সে সিলিকন ভ্যালির চাকুরে। খরচটা কোনও সমস্যাই নয়। রাজস্থানি থিমে সাজানো হয়েছিল শহরের এক পাঁচতারা হোটেলের চত্বর।” শুধু পাঁচতারা হোটেল নয়, নিক্কো পার্ক বা নলবনও এখন বিয়ের অনুষ্ঠানের ‘হট প্রপার্টি’। নলবনের জলে শিকারা করে বিয়ে করতে আসছেন বাঙালি বর-বৌ। কিংবা টাইটানিকের ছাঁদে নৌকো ভাসিয়ে বসছে বিয়ের আসর। তাই বলে বিয়ের হৃদয়টা কিন্তু পাল্টাচ্ছে না। আন্তর্জাতিক থিমের বিয়ের মঞ্চে বাঙালি টোপর আর শোলার মুকুট পরেই মন্ত্র পড়ছেন বর-কনে।
খরচ:

স্টার পাওয়ার
অর্থাৎ গ্লোবাল বাঙালি কিন্তু বিয়ের গভীরে থাকা আচারগুলির মধ্যে কোনও খাদ ঢুকতে দিচ্ছে না। কী রকম? দাদামশাইয়ের বাল্যবন্ধুর ছেলে বা মেজমামার শালিকে নিমন্ত্রণ করাটা এখন আর এক নম্বর লিস্টে থাকে না ঠিকই। থিম বিয়ের নিমন্ত্রিতের তালিকা এখন আলো করেন তারকারা। শাহরুখ খান, সলমান খান, দীপিকা পাডুকোন থেকে শুরু করে রাখি সাওন্ত-সহ ছোট পর্দার ‘পেজ থ্রি’রা। সেখানেও বলিউডের সঙ্গে টলিউডকেও মিশিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে নিয়মিত। কী রকম? বাংলা ছবির হার্টথ্রব দেবের কাছেও বিয়ের আসরে মুখ দেখানোর অফার আসে অহরহ। অবশ্য এখনও শাহরুখদের মতো এই কাজটাকে প্রফেশনালি নেওয়া শুরু করেননি তিনি “এখন খুব ব্যস্ত। পরে ভেবে দেখা যাবে,” বক্তব্য তাঁর। তবে বাংলা টেলিভিশনের চেনা মুখ কিংবা রিয়্যালিটি শোয়ের বাঙালি গায়ক-গায়িকারা কিন্তু বিয়ের বাজার দাপিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। এবং সে ক্ষেত্রে খরচটাও কমে হাজার ২৫ থেকে এক লাখের মধ্যে হয়ে যায়। আর গানের মধ্যে সব চেয়ে বেশি চাহিদা? “হেমন্ত-মান্নার গান। তার সঙ্গে হিন্দি গানের চাহিদাও আছে,” জানাচ্ছেন কলকাতার এক ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট সংস্থার অধিকর্তা সঞ্জয় অগ্রবাল। আসর জমাতে গান গাইতে পারেন সোনু নিগম, শান, সুখবিন্দর সিংহ, সুনিধি চৌহান। যত কড়ি, তত বড় তারকা। “ঘণ্টা খানেকের জন্য শাহরুখ, সলমনের দর পাঁচ কোটির ওপর। রাখির পাঁচ থেকে ছয় লাখ,” জানালেন দিল্লির ইভেন্ট ম্যানেজার কবিতা। “চলতি ট্রেন্ডে কলকাতায় বিয়ের অনুষ্ঠানে নিয়মিত হাজিরা দেন আমির আলি, সনজিদা শেখ, হুসেন, টিনাদের মতো টিভির তারকারা। তাঁদের নাচ আর মুচমুচে আ্যঙ্করিং নিয়ে,” জানালেন সঞ্জয়।
খরচ:

বিয়ে নামের ফ্যাশন শোয়ে
কলেজ স্ট্রিট বা গড়িয়াহাটের শাড়ির দোকান থেকে কেনা বেনারসি আর ঢাকাই মসলিন অতীত। শর্বরী দত্ত, সব্যসাচী মুখোপাধ্যায় আর রিতু কুমারদেরই রমরমা আজকাল। বাঙালি বিয়ে যে এখন মেগা ফ্যাশন শো-ও। তাই বলে বেনারসিকে উড়িয়ে কনের গায়ে লহেঙ্গা চোলি বা ধুতি-পাঞ্জাবির বদলে কুর্তা-চুড়িদার উঠছে বরের গায়ে, এমন কিন্তু নয়। “বিশুদ্ধ পাঞ্জাবির এখন অনেক রূপ আঙরাখা, আচকান, শেরওয়ানি, বন্ধগলা। সেখানে গ্রাফিক্স, অ্যাবস্ট্র্যাক্ট আর্ট যেমন থাকছে, তেমন শঙ্খ পাড়ও। তবে চুনোট-করা সুতির ধুতি নেই। এখন যুগ সিল্কের,” বলছিলেন শর্বরী দত্ত।
ও দিকে কনের বেনারসির সঙ্গে সারা বাড়ির বাকি মহিলাদের জন্যও ডিজাইনারের কাছে অর্ডার যাচ্ছে। বাঙালি বিয়েতে ডিজাইনার পোশাক পরার ঘটা যে গত তিন চার বছরে গড়ে ৩০ শতাংশ বেড়েছে, স্বীকার করছেন ডিজাইনার অভিষেক দত্ত। “বাড়িতে বিয়ে লাগলে ইদানীং ডিজাইনারের কাছে চলে আসছে পুরো পরিবারই। একটা বিয়েবাড়িতে সবাইকে সাজাতে খরচ হয়ে যাচ্ছে ৫০ লক্ষ থেকে এক কোটি টাকা,” জানাচ্ছেন তিনি। রিতু কুমার বলছেন, “আজকাল সবাই ডিজাইনার পোশাকে সাজতে চান। বিয়ের অনুষ্ঠানও অনেক লম্বা চওড়া হয়ে গেছে। মেহেন্দি, সঙ্গীত, আরও অনেক প্রথা মিলিয়ে প্রায় এক ডজন অনুষ্ঠান।” বাঙালি বিয়েতেও এখন অন্য রাজ্যের ট্র্যাডিশন ঢুকে পড়েছে। গায়ে হলুদের পাশে দিব্যি জায়গা করে নিয়েছে সঙ্গীত। আর এক-একটা অনুষ্ঠানের জন্য এক-এক রকমের ডিজাইনার পোশাক। “কলকাতায় কেউ কেউ এক বা দুই লক্ষ টাকার বিয়ের পোশাক কিনছেন আজকাল,” বলছেন রিতু।
খরচ:

এখন যেমন হয়

মনের রং, মুখের রং
বাঙালি বনেদি পরিবারে বিয়ের মেক-আপে আমূল বদলেছে কনের মানসিকতা, বলছিলেন মেক-আপ আর্টিস্ট অনিরুদ্ধ চাকলাদার। “আগে বাঙালি মেয়েরা বিয়ের জন্যে এটা-ওটা কিনে মেক-আপ করাতে চলে আসতেন। এখন অনেকেই শাড়ি, গয়না বা মেক-আপ কিনতে যাওয়ার আগে ফোন করেন। জিজ্ঞেস করেন, তাঁকে কী মানাবে। থিম অনুযায়ী সাজতে হলে কী কিনবেন। লোকাল ব্র্যান্ড না কিনে কয়েক হাজার টাকা খসিয়ে আন্তর্জাতিক মেক-আপ ব্র্যান্ড কিনে আনেন,” জানাচ্ছেন অনিরুদ্ধ। এখানেও গড়পড়তায় সাজের চাকচিক্যের দিকে ঝোঁক বেড়েছে। বিয়ের থিম বুঝে সাজছেন বর-কনে। কপালে চন্দনের কারুকাজের সঙ্গে হাত ভরা মেহেন্দিতে মিশে যাচ্ছে বাঙালি আর অবাঙালি সংস্কৃতি।
গোলপার্কের একটি বিখ্যাত বাঙালি গয়নার দোকানের ফ্লোর ম্যানেজার বললেন, “বিয়েতে বাঙালি গয়নার চাহিদা ভালই। তবে অবাঙালি ডিজাইনও এখন দারুণ চলছে। সে ক্ষেত্রে টাকার অঙ্কটা নিয়ে মাথাও ঘামাচ্ছেন না ক্রেতারা।” তানিস্কের রিজিওনাল ম্যানেজার দ্বৈপায়ন সেনও জানাচ্ছেন সোনা নয়, বাঙালিদের মধ্যে এখন সব থেকে বেশি হুজুগ কুন্দনের সঙ্গে হিরের গয়নার। “হিরের একটা সেটের দাম পড়ছে পাঁচ থেকে দশ লাখের মধ্যে। সিঙ্গল সলিটেয়ার পাথর বসানো গয়নার দাম একটু বেশি। এক ক্যারাটের দাম দেড় লাখ থেকে শুরু,” জানাচ্ছেন তিনি।
খরচ:

পেট পুজো
যেমন গয়নায়, তেমনই খাওয়া-দাওয়ায়। পাড়ার কেটারার আর মন ভরাতে পারছে না। বাঙালি বিয়ে জাতে উঠতে চাইলে ব্যবস্থায় এখন ওহ্ ক্যালকাটা! বা সিক্স বালিগঞ্জ প্লেসের মতো বিখ্যাত রেস্তোরাঁ। সিক্স বালিগঞ্জ প্লেসের খবর মাছ, মুরগি, মাংসবাঙালিয়ানার যা যা প্রয়োজন সবই থাকছে আজকালকার মেগা বিয়ের মেনুতে। সঙ্গে ঢুকছে কন্টিনেন্টাল, মোগলাই, চাইনিজ এবং তন্দুর মেনু। লাইভ কাউন্টারেরও এখন খুব প্রচলন। তার মধ্যে আছে টেপনইয়াকি, পরোটা, পাস্তা, বিরিয়ানি আর ডেজার্ট কাউন্টার। ‘ওহ্! ক্যালকাটা’র কর্ণধার অঞ্জন চট্টোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, “থিম বিয়ে বুঝে খাওয়া তো আছেই। গেস্টদের তুষ্ট করতে বাঙালি বিয়ে বাড়িতে ঢুকে পড়ছে ভিন প্রদেশের রান্নাবান্না। তন্দুরি পনিরের সঙ্গে মিশছে তন্দুরি চিকেন। লুচি, আলুর দম, ছোলার ডাল, ফিশ ফ্রাই আছে। কিন্তু ছানার ডালনার জায়গায় পনিরের নানা পদের জায়গা এখন পাকাপাকি।” এ সবের সঙ্গে যোগ হতেই পারে গলদা চিংড়ি, ভেটকি ফ্রাই। দই, সন্দেশ, রসগোল্লা এখনও জায়গা ধরে রাখছে বটে, কিন্তু সঙ্গে মোতিচুরের লাড্ডু বা জিলিপিও আস্তে আস্তে বাঙালি বিয়েবাড়ির মেনুতে ঠাঁই পাচ্ছে।
আর মদ্যপান? সেটাও চালু আজকাল। দক্ষিণ কলকাতা সংসদে আয়োজিত এক বিয়ের অনুষ্ঠানে মূল খাবারের টেবিলের একটু দূরে পানীয়ের ব্যবস্থাও ছিল। বাঙালিয়ানা মেনে নির্দেশ ছিল অতিথিরা যেন পানীয় নিয়ে মূল খাবারের জায়গায় ভিড় না করেন।
খাওয়ানোর খরচ:

আসল সুতো যাঁদের হাতে
হিট ছবি ‘ব্যান্ড বাজা বারাত’ মনে আছে তো? যার মূলে ছিল ওয়েডিং প্ল্যানিং। “ওয়েডিং প্ল্যানিং এখন রমরমা ব্যবসা। বাড়ির লোকজনেরা এখন ছুটে বেড়াবার বদলে, বিয়েটা এনজয় করতেই ভালবাসেন। বাকিটা ওয়েডিং ম্যানেজারেরাই সামলায়। ‘ব্যান্ড বাজা বারাত’-এ আমরা যেমন সামলেছি,” বলছেন নায়িকা অনুষ্কা শর্মা। ছোট, মাঝারি, বড়সড় অনেক ধরনের ওয়েডিং প্ল্যানার আছেন। পকেট বুঝে তাঁদের দলে টেনে নিন।
খরচ:

ইন আউট
• ডেকরেশনে অর্কিড
• ফুল সাজানো শিকারা, হেলিকপ্টার
• মেহেন্দি, সঙ্গীত
• নিমন্ত্রিতের তালিকায় পেজ থ্রি স্টার
• অভিজাত ক্লাবে রিসেপশন
• বিখ্যাত রেস্তোরাঁর খাবার
• ডেকরেশনে রজনীগন্ধা
• ফুল দিয়ে সাজানো অ্যাম্বাসাডর
• আলতা, জল সইতে যাওয়া
• নিমন্ত্রিতের তালিকায় দাদামশাইয়ের ছোটবেলার বন্ধু
• প্যান্ডেল বেঁধে বা বাড়ি ভাড়া করে বৌভাত
• পাড়ার কেটারার





First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.