অবশেষে ইয়েমেনেও জমানা-বদল ঘটিল। তেত্রিশ বছরের একচ্ছত্র শাসক আলি আবদুল্লা সালে ক্ষমতা ছাড়িয়া রাজনৈতিক নির্বাসনে গেলেন। তাঁহার এই বিলম্বিত প্রস্থানলগ্ন অবশ্য শান্তিপূর্ণ থাকে নাই। তাঁহারই অনুগত সশস্ত্র ব্যক্তিদের আক্রমণে অন্তত পাঁচজন বিক্ষোভকারী নিহত হইয়াছেন। এই হত্যাকাণ্ডের জন্য সালে দুঃখপ্রকাশ করিয়াছেন, দোষীদের কড়া শাস্তির পক্ষেও সওয়াল করিয়াছেন। আরব দুনিয়ায় যেন দুঃখপ্রকাশের ধুম পড়িয়া গিয়াছে। মিশরের তাহরির স্কোয়ারে গত কয়েক দিনের বিক্ষোভে পুলিশের গুলিচালনায় যে ৩৫ জনের মৃত্যু হইয়াছে, তাহার জন্য সে দেশের শাসক সামরিক পরিষদও ‘গভীর দুঃখ ও বেদনা’ ব্যক্ত করিয়াছে। অথচ বিক্ষোভকারীরা সামরিক পরিষদের ক্ষমতা ত্যাগ এবং সোমবার অনুষ্ঠেয় পার্লামেন্টের নির্বাচন স্থগিত করার যে-দাবি জানাইয়াছিলেন, তাহা মানা হয় নাই। বরং বিক্ষোভে লিপ্ত না হইয়া সামরিক কর্তারা জনসাধারণকে ভোটের জন্য প্রস্তুত হওয়ার পরামর্শ দিয়াছেন।
আরব বসন্ত হইতে জুঁই ফুলের সৌরভ অতএব ক্রমেই অন্তর্হিত হইতেছে। টিউনিসিয়া ও মিশরের রক্তপাতহীন জমানা-বদলের পর ইয়েমেন, বাহরিন ও লিবিয়ায় তো কার্যত রক্তের প্লাবন বহিয়া গিয়াছে। আলি আবদুল্লা সালে অগত্যা ক্ষমতা ছাড়িতে সম্মত হইলেও ইয়েমেনে সত্যকার জমানা-বদল হইবে কি না, সেটা নির্ভর করিতেছে তাঁহার উত্তরসূরির উপর। লিবিয়াতে গদ্দাফি নিহত হওয়ার পর এত দিনে প্রধানমন্ত্রী আবদুর রহিম আল-কাইবের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার কোরান ছুঁইয়া দেশকে সুশাসন দিবার শপথ লইয়াছে বটে। কিন্তু আগামী বছর জুনে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনের পরবর্তী রাজনৈতিক সমীকরণেই স্পষ্ট হইবে, লিবিয়া গণতন্ত্রের পথে হাঁটিতে চায় কি না। ইতিমধ্যে টিউনিসিয়ায় নির্বাচনে গরিষ্ঠতার সুবাদে ইসলামপন্থী এন্নাহ্দা পার্টি কোয়ালিশন সরকার গড়িলেও শরিয়তি শাসন আর সাংবিধানিক গণতন্ত্রের মধ্যে কতখানি আপস করে, তাহাও নিশ্চিত নয়। তবে এটা নিশ্চিত যে সিরিয়ায় জমানা-বদল রীতিমত রক্তাক্ত হইতে চলিয়াছে। আরব লিগ ও নিরাপত্তা পরিষদের নির্দেশ অগ্রাহ্য করিয়া সিরিয়ার সরকার একতরফা দমননীতি চালাইতেছে। ইতিহাসে ইহার প্রতিবিধান অবশ্যম্ভাবী।
প্রেসিডেন্ট আসাদ স্পষ্টতই ইয়েমেনের আবদুল্লা সালের কাছ হইতে কিছু শেখেন নাই। তিনি ইহা উপলব্ধি করিতে অপারগ যে, তাঁহার পতন কেবল সময়ের অপেক্ষা। জনসাধারণ গণতন্ত্রের উদ্বোধন চায়। তুরস্ক ও লেবাননের মতো মিত্রভাবাপন্ন রাষ্ট্রও তাঁহাকে সরিয়া দাঁড়াইবার সেই সদুপদেশই দিয়াছে। কিন্তু ইরান এবং আল হামাসের পরামর্শই ইদানীং তিনি বেশি শুনিতেছেন। এ দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাহার নাগরিকদের যত দ্রুত সম্ভব সিরিয়া ছাড়ার নির্দেশ দেওয়ায় মনে হইতেছে, ন্যাটো লিবিয়ার পর সিরিয়ায় জমানা-বদলে অনুঘটকের ভূমিকা পালনে প্রস্তুত হইতেছে। দেশে-দেশে আরব বসন্তের এই দখিনা বাতাস মুসলিম জনসমাজ সম্পর্কে অনেক পূর্বধারণাকেই ভ্রান্ত প্রতিপন্ন করিয়াছে। বিশ্বের অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মতো মুসলিমরাও যে গণতন্ত্র ও উদারনীতির পক্ষপাতী, স্বৈরাচারের নয়, তাহা স্পষ্ট। শরিয়তি রক্ষণশীলতার সঙ্গে সেই উদারনীতির দ্বন্দ্ব কোন পথে অগ্রসর হয়, তাহাই অতঃপর পশ্চিম এশিয়ায় দ্রষ্টব্য। |