সঙ্কটই সংস্কারের জননী। অন্তত ভারতে। ১৯৯১ সালের সঙ্কটের ধাক্কায় আর্থিক সংস্কারের সূচনা হইয়াছিল। সেই সংস্কারের ভগীরথ দুই দশক পরে নূতন সঙ্কটে। তাঁহার প্রধানমন্ত্রিত্বের ইহাই কঠিনতম পর্ব। টাকার দাম সর্বনিম্ন স্তরে পৌঁছাইয়াছে, বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ক্রমবর্ধমান, মূল্যস্ফীতি বেলাগাম। এই সঙ্কট ভারতে দ্বিতীয় প্রজন্মের আর্থিক সংস্কারের সূচনা করিল। সংগঠিত খুচরা ব্যবসায়ে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের পথে আর বাধা রহিল না। অনুমান করা সম্ভব, এই সিদ্ধান্তটি লইতে যথেষ্ট সাহসের প্রয়োজন পড়িয়াছে। ‘সংস্কার’ শব্দটিকে ভারতীয় রাজনীতি এখনও হজম করিতে পারে নাই। তাহার উপর, মনমোহন সিংহের সরকার এখন বহু শরে বিদ্ধ। লাগামহীন মূল্যস্ফীতি, নেতাদের বিরুদ্ধে সর্বব্যাপী দুর্নীতির অভিযোগ, অর্থনীতির শ্লথগতি প্রতিটি সমস্যারই শাসক দলের সাহসের শেষ বিন্দু পর্যন্ত কাড়িয়া লইবার ক্ষমতা রহিয়াছে। এই অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী যে দ্বিতীয় প্রজন্মের সংস্কারের পথে হাঁটিতে ভয় পান নাই, সর্বদলীয় সম্মতির অপেক্ষায় বসিয়া থাকেন নাই, তাহার জন্য তাঁহার বিপুল অভিনন্দন প্রাপ্য।
এক জন অবশ্য অভিনন্দন জানাইতে নারাজ। তাঁহার নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার যে বৈঠকে খুচরা বিক্রয়ে বিদেশি লগ্নিকে ছাড়পত্র দেওয়ার সিদ্ধান্তটি লওয়া হয়, সেই বৈঠকে ঢুকিবার পূর্বে রেলমন্ত্রী দীনেশ ত্রিবেদী বলিয়াছিলেন, তিনি প্রস্তাবটির দুইশত শতাংশ বিরোধিতা করিবেন। সেই প্রতিজ্ঞা তাঁহার দল ইতিমধ্যেই অক্ষরে অক্ষরে পালন করিয়াছে। বিরোধিতা মন্ত্রিসভার বৈঠকে শেষ হয় নাই। শুক্রবার লোকসভায় তৃণমূল কংগ্রেস এই সিদ্ধান্তের এমনই বিরোধিতা করিয়াছে যে সভা মুলতবি রাখিতে হইল। দুই দিন মিলাইয়া দুই শত শতাংশ বিরোধিতা সম্পন্ন। অনুমান করা যায়, অতঃপর শতাংশ বাড়িবে। এই বিরোধিতা, স্পষ্টতই, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-অনুমোদিত। একটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বিদেশি বিনিয়োগে আপত্তি করিতেছেন, এমন দৃষ্টান্ত বিরল। বিদেশি বিনিয়োগের বিরোধিতা যে দলের একচেটিয়া অধিকারের তালিকায় পড়ে, সেই সি পি আই এম-এর বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যও মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন প্রত্যক্ষ বিদেশি পুঁজির পক্ষে কথা বলিয়াছিলেন। তাহাই স্বাভাবিক। কারণ, যাঁহাকে রাজ্য চালাইতে হয়, অর্থ সংস্থানের কথা ভাবিতে হয় তাঁহার পক্ষে বাস্তববাদী হওয়া ভিন্ন উপায় নাই। দুঃখের কথা, শ্রীবন্দ্যোপাধ্যায় চোখ বুজিয়া থাকিলেন। ‘পরিবর্তন’-এর হাওয়ায় ভর করিয়া তিনি পশ্চিমবঙ্গের মসনদে অধিষ্ঠিত হইয়াছেন। কিন্তু, তাহা নিতান্তই বাহ্যিক পরিবর্তন। মানসিকতায় কোনও পরিবর্তন আসে নাই। একুশ শতকের বিশ্ব-অর্থনীতি কোন পথে হাঁটিতেছে, তাহা বুঝিতে তিনি ব্যর্থ। খুচরা বিক্রয়ে বিদেশি বিনিয়োগ আসিলে আখেরে যে সাধারণ মানুষেরই লাভ, এই কথাটি তিনি বুঝিয়াও বুঝেন নাই। তিনি তাঁহার বামপন্থায় অবিচলিত রহিয়াছেন।
বস্তুত, শ্রীবন্দ্যোপাধ্যায় বামপন্থী সাইনবোর্ডধারীদের বেজায় বেকায়দায় ফেলিয়াছেন। তিনি যে ভাষায়, যে যুক্তিতে এই সংস্কারের বিরোধিতা করিয়াছেন, তাহা বামপন্থীদের ভাষা, বামপন্থীদের যুক্তি। তৃণমূল সাংসদরা যখন এই বিলের বিরোধিতায় সরব হইয়াছিলেন, তখন তাঁহাদের সঙ্গে গলা মিলাইতে বামপন্থীরা ইতস্তত করেন নাই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বামপন্থার প্রতি নিষ্ঠায় তাঁহাদের বিশ্বাস আছে। এখন শ্রীবন্দ্যোপাধ্যায়ের নিকট প্রশ্ন: তিনি কি ইতিহাসের পাতায় এই বিশ্বের শেষ বামপন্থী হিসাবে পরিচিত হইতে চাহেন? যদি তাহাই বাসনা হয়, তবে তিনি যথার্থ পথে হাঁটিতেছেন। কলিকাতার বাস কন্ডাকটরদের ভাষায়, তিনি ‘পিছন দিকে আগাইয়া যাইতেছেন’। কিন্তু, যদি তিনি পশ্চিমবঙ্গের পরিবর্তনের কান্ডারি হিসাবে জ্ঞাত হইতে চাহেন, তবে তাঁহার স্কন্ধারূঢ় এই বামপন্থার ভূতটিকে অবিলম্বে ঝাড়িয়া ফেলিতে হইবে। অর্থনীতির যুক্তিকে অগ্রাহ্য করিয়া, কাণ্ডজ্ঞান বিস্মৃত হইয়া পরিবর্তনের ধ্বজাধারী হওয়া যায় না। এখন প্রশ্ন: তিনি কী চাহেন? সিদ্ধান্ত করিবার ইহাই শেষ সুযোগ। |