|
|
|
|
|
|
|
চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১... |
|
জীবন ভাবনা ও আঙ্গিক নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা |
সম্প্রতি ইমামি চিজেলে শুভাপ্রসন্ন-র একক প্রদর্শনী দেখে এলেন মৃণাল ঘোষ |
শুভাপ্রসন্ন-র বিগত চার দশকের নানা আঙ্গিক ও নানা মাধ্যমের কাজ থেকে এক শতাধিক চিত্র, রেখাচিত্র, ছাপচিত্র ও ভাস্কর্য নিয়ে পূর্বাপর প্রদর্শনী হল সম্প্রতি ইমামি চিজেল আর্ট গ্যালারিতে। ১৯৭০এর দশকে প্রতিষ্ঠাপ্রাপ্ত এই শিল্পী ১৯৬০এর দশকে উদ্ভাবিত ভারতীয় আধুনিকতাবাদী চিত্রকলার যে বিশেষ ধারা তাকেই প্রসারিত করে নিয়ে এসেছেন। অত্যন্ত পরিশ্রমী, স্বতঃস্ফূর্ত এবং সামাজিক দায়বোধে উদ্বুদ্ধ এই শিল্পী নানা আঙ্গিকে নিরন্তর কাজ করে আসছেন। তাঁর প্রকাশের ভিত্তিতে রয়েছে স্বাভাবিকতাবাদী চিত্রকলায় অসামান্য দক্ষতা।
ঊনবিংশ শতকে আমাদের চিত্রকলায় আধুনিক চেতনার প্রথম উদ্ভব ঘটে। রবি বর্মা বা বামাপদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো সে যুগের আরও অনেক শিল্পী প্রতিকৃতি চিত্রের পাশাপাশি দেশীয় পৌরাণিক ও পুরাণকল্পমূলক বিষয় নিয়ে কাজ করে গেছেন। বিংশ শতকের গোড়া থেকে এই বিদেশি আঙ্গিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে ওঠে নব্য ভারতীয় ধারার বিকাশের মধ্য দিয়ে। কিন্তু পাশাপাশি এই স্বাভাবিকতার আঙ্গিকও অপ্রতিহতভাবে প্রবাহিত হয়েছে। ১৯৩০ ও ৪০এর দশকে প্রথম পর্বের যামিনী রায়, হেমেন মজুমদার, অতুল বসু প্রমুখ শিল্পীর কাজে এর পরিচয় রয়েছে। ১৯৭০এর দশকে যাঁরা এই ধারাকে প্রসারিত করেছেন শুভাপ্রসন্ন তাঁদের অন্যতম। |
|
শিল্পী: শুভাপ্রসন্ন |
নানা রকম রূপরীতি নিয়ে তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন বিভিন্ন সময়ে। অভিব্যক্তিবাদ থেকে ফ্যানটাসি বা কল্পরূপের নানা পর্যায় অতিক্রম করে সুররিয়ালিজমের দিকেও গেছেন। এ সমস্ত কিছুরই ভিত্তিতে থেকেছে তাঁর নিমগ্ন সমাজ চেতনা ও রাজনীতি চেতনা। ১৯৭১এ ‘ম্যান অ্যান্ড স্পেস’ ও ‘ল্যামেন্ট চিত্রমালা’, ১৯৭২এ ‘টাচ’, ১৯৭৫এ ‘ড্রিম’, ‘ইলিউশন’, ১৯৭৭-৭৮এ ‘টাইম’, ‘ইলিউশন’, ১৯৭৯এ ‘অ্যাবোড’, ১৯৮১এ ‘র্যাপড’, ১৯৮৩এ ‘অ্যামফিবিয়াস’, ‘বার্ডস’, ১৯৮৯এ ‘ক্যালকাটা ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট’, ১৯৯২এ ‘উইংস অব নো এন্ড’, ১৯৯৩-৯৭এ ‘মেট্রোপলিস: পোরট্রেটস অব ক্যালকাটা‘ ও ‘মিডলটোনস’, ১৯৯৮ থেকে ২০০৫এর মধ্যে ‘আইকনস’, ‘লীলা’, ‘দ্য গোল্ডেন ফ্ল্যুট’, ২০০৮এ ‘নাইট ওয়াচ’, ২০০৯এ ‘এক্সপ্রেশনস’ - এ সমস্ত চিত্রমালায় তাঁর জীবন ভাবনা ও আঙ্গিক নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার নানা দিক উঠে এসেছে। প্রায় সব চিত্রমালারই কিছু কিছু দৃষ্টান্ত এই প্রদর্শনীতে ছিল। তারই কয়েকটি দৃষ্টান্ত আমরা দেখব।
১৯৬৯এর ‘ট্রাভেইল’ শীর্ষক তেলরঙের ছবিতে গর্ভবতী নারীর উপস্থাপনা বা ১৯৭১এর ‘ল্যামেন্ট’ ছবিতে দুঃস্থ নারী ও শিশুর যে প্রকট যন্ত্রণা, তাকে প্রকাশ করতে তিনি স্বাভাবিকতাকে ভেঙে অন্ধকারময় অভিব্যক্তিবাদী দীর্ণ আঙ্গিক নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। ১৯৭৩এর ‘ইলিউশন’ ছবিতে খাটিয়ার উপর শায়িত একটি মৃতদেহের উপস্থাপনা। তার পা দুটি প্রকটভাবে দৃশ্যমান। দুটি জীবন্ত হাত মৃতদেহের দিকে প্রসারিত। উপরে দুটি প্রজাপতি উড়ছে।
১৯৮০র দশকে পাখি, মাছ বা অন্যান্য পশুর রূপায়ণেও প্রতীকী ব্যঞ্জনা এসেছে। ১৯৯১এর একটি লিথোগ্রাফ ‘দ্য হ্যান্ডস’, হাতে প্লাস্টার করা, মাথায় ব্যান্ডেজ করা একটি আহত মানুষের উপস্থাপনা। ১৯৯৪এর ‘রুট নম্বর ৭ ও ৮’ কলকাতার উপস্থাপনায় তাঁর স্বাভাবিকতার আঙ্গিকে দক্ষতার দৃষ্টান্ত। একটি ট্রাম এগিয়ে আসছে। লাইনের উপর নির্বিকারভাবে বসে আছে একটি গরু। ১৯৯৫এর ‘মিডলটোন’ চিত্রমালায় এই শহরের স্থাপত্য ও প্রকৃতির নিঃস্বতাকে এঁকেছেন স্বাভাবিকতাকে জ্যামিতিকতায় বিশ্লিষ্ট করে। ১৯৯৩এর ‘আ প্রসেশন’ ছবিটি এই শিল্পীর বাস্তববোধ ও কৌতুকবোধের, রিয়েলিটি ও ফ্যানটাসির সমন্বয়ের অসামান্য দৃষ্টান্ত। শহরের পথে টানা রিকশায় কালী মূর্তি নিয়ে যাচ্ছে শিববেশী রিকশা চালক। এই কলকাতা শহরের বিপন্নতা, এর বৌদ্ধিক উৎকর্ষ ও জীবনযাপনের দারিদ্রের দ্বন্দ্ব তাঁর ছবিতে বার বার এসেছে। ১৯৮৯এর ‘পোয়েটস ড্রিম’ ও ‘দ্য কিড’ ছবি দুটি এ প্রসঙ্গে বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
তাঁর ভাস্কর্য ছবির প্রকাশভঙ্গির সমান্তরাল হলেও ত্রিমাত্রিকতায় নিঃসীম এক কৌতুকবোধকে তিনি প্রগাঢ় করে তুলতে পারেন। |
|
|
|
|
|