‘রুষ্ট’ মুখ্যমন্ত্রীও
মঞ্চে ভারভারা, সরকারের সঙ্গে সংঘাতেই এপিডিআর
শুরু হয়েছিল মহাশ্বেতা দেবীকে দিয়ে। এ বার মঞ্চে ভারভারা রাও। কিষেণজি’র মৃত্যুকে কেন্দ্র করে মানবাধিকার সংগঠন গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা কমিটির (এপিডিআর) সঙ্গে রাজ্য সরকারের কার্যত সম্মুখ সমর বাধল।
এপিডিআর-সহ ২১টি গণ সংগঠনকে মেট্রো চ্যানেলে সভা করতে না-দেওয়ার ঘটনা নিয়ে উদ্ভুত পরিস্থিতিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের সঙ্গে ফ্যাসিবাদের তুলনা টেনেছিলেন মহাশ্বেতাদেবী। তার কয়েক দিনের মধ্যেই এপিডিআর-এর মঞ্চ থেকে অন্ধ্রপ্রদেশের কবি এবং মাওবাদী ‘ঘনিষ্ঠ’ ভারভারা রাও ভুয়ো সংঘর্ষে কিষেণজি’র মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ করে ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত দাবি করলেন। এতে যেমন এক দিকে এপিডিআর-এর মতো সংগঠনের তরফে সরকার-বিরোধিতার সুর চড়া হল, তেমনই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও তাদের বিরুদ্ধে ‘মাওবাদীদের মুখোশ’ তকমা ব্যবহারের আরও সুযোগ পেয়ে গেলেন!
কিষেণজি’র মৃত্যু এবং এপিডিআর-এর সংঘাত এই ঘটনাপ্রবাহের জেরে সরকারের সঙ্গে মাওবাদীদের শান্তি প্রক্রিয়া বিশ বাঁও জলে চলে গেল। মানবাধিকার সংগঠনগুলির ঘনিষ্ঠ মধ্যস্থতারীদের উপরে গত কিছু দিন যাবৎই ‘ক্ষুব্ধ’ ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। এর পরে এপিডিআর-এর মঞ্চ থেকেও শুক্রবার মধ্যস্থতাকারীদের পদত্যাগের দাবি উঠেছে।
বৌবাজারে গত দু’দিন অনশন-অবস্থান করার পরে এ দিন সেখান থেকে মিছিল করে মহাকরণের দিকে যাওয়ার এবং যৌথ বাহিনী প্রত্যাহার, রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি-সহ একাধিক দাবিতে রাজ্য সরকারকে স্মারকলিপি দেওয়ার কথা ছিল এপিডিআর-এর। সেই কর্মসূচি তারা পালনও করেছে। কিন্তু কিষেণজির মৃত্যু গোটা ঘটনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছে। এপিডিআর-সহ ২১টি সংগঠনের পক্ষ থেকে সরাসরি অভিযোগ তোলা হয়েছে, কিষেণজি’কে ভুয়ো সংঘর্ষে খুন করা হয়েছে। তারা গোটা ঘটনার তদন্ত দাবি করেছে।
পুলিশ এ দিন মহাকরণের অদূরে ওই সংগঠনগুলির মিছিল আটকে দেয়। বি বি গাঙ্গুলি স্ট্রিটে ম্যাটাডোর ভ্যানে অস্থায়ী মঞ্চ করে তারা সভা শুরু করে। সেই সভায় কিছু ক্ষণ পরে এসে যোগ দেন ভারভারা রাও এবং কিষেণজি’র ভাইঝি দীপা রাও। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন অন্ধ্রপ্রদেশের সিভিল লিবার্টি কমিটির সম্পাদক চন্দ্রশেখর। সকলেই এক সুরে অভিযোগ তোলেন, ভুয়ো সংঘর্ষে কিষেণজি’কে খুন করা হয়েছে। এমন কথাও বলা হয়, রাজ্য প্রশাসন শান্তি আলোচনার জন্য কিষেণজি’কে এ রাজ্যে ডেকে এনে বুধবার গ্রেফতার করে এবং শারীরিক নির্যাতনের পরে বৃহস্পতিবার ঠান্ডা মাথায় তাকে গুলি করে মারে।
ভারভারা স্লোগান তোলেন, “কিষেণজি লাল সেলাম!” সভায় উপস্থিত এপিডিআরের সদস্যেরাও তাতে গলা মেলান। সব মিলিয়ে এপিডিআরের সভামঞ্চ কার্যত রাজ্য সরকার-বিরোধিতার মঞ্চে পরিণত হয়।
দিল্লি থেকে কলকাতায় নামা মাত্রই মুখ্যমন্ত্রী মমতা এ দিনের যাবতীয় ঘটনার খবর পান। এপিডিআর-এর মঞ্চে ভারভারা গিয়েছেন এবং সেখান থেকে কিষেণজি’র ‘হত্যা’র তদন্তের দাবি তোলা হয়েছে শুনে ঘনিষ্ঠ মহলে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, কারা মাওবাদীদের ‘মুখোশ’, এ বার ভালই বোঝা যাচ্ছে! মাওবাদীদের প্রতিই বেশি ‘দুর্বলতা’ দেখানোর জন্য মধ্যস্থতাকারী সুজাত ভদ্রদের ভূমিকায় ইতিমধ্যেই ‘রুষ্ট’ ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। মধ্যস্থতাকারীরা যে সব সংগঠনের সঙ্গে জড়িত, কিষেণজির মৃত্যুর প্রেক্ষিতে তাদের ভূমিকায় মুখ্যমন্ত্রীর ক্ষোভ আরও বেড়েছে। অন্য দিকে, মাওবাদীরাও স্পষ্ট করে দিয়েছে, শান্তি প্রক্রিয়ার আর জায়গা নেই। সব মিলিয়ে, শান্তি আলোচনার ভবিষ্যৎ এখন পুরোপুরিই অনিশ্চিত।
পরে পিকনিক গার্ডেনে এ দিন সন্ধ্যায় দক্ষিণ কলকাতা লোকসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনের প্রচারে গিয়ে মমতা বলেন, “আমি সমালোচনা পছন্দ করি। তা হলে আরও ভাল কাজ করা যায়। কিন্তু আমরা উন্নয়নের কাজ যাতে না-করতে পারি, সেই জন্য কেউ কেউ বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। তাঁদের একটা মুখ, আর একটা মুখোশ!” মহাশ্বেতাদেবীর নাম না-করেই মুখ্যমন্ত্রীর আরও বক্তব্য, “কেউ কেউ আমার বিরুদ্ধে কলাম লিখছেন। কিন্তু তাঁরা কি জানেন, ছ’পয়সায় কী ভাবে সরকার চালাতে হচ্ছে!” তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, “এক টাকার মধ্যে ৯৪ পয়সাই চলে যায় আগের সরকারের রেখে যাওয়া ঋণের সুদ দিতে, সরকারি কর্মীদের মাইনে ও পেনশন দিতে। বাকি ছ’পয়সায় উন্নয়ন, বঙ্গবিভূষণ এবং জঙ্গলমহলে নিরন্ন মানুষের মুখে খাদ্য তুলে দিতে খরচ করতে হয়!”
রাজ্য সরকার নিযুক্ত মধ্যস্থতাকারী দলের অন্যতম সদস্য তথা বন্দিমুক্তি কমিটির নেতা ছোটন দাস এ দিন এপিডিআর-এর সভায় ছিলেন। সভা থেকে ভারভারা-সহ অন্য নেতারা দাবি তোলেন, অবিলম্বে মধ্যস্থতাকারীদের পদত্যাগ করতে হবে। ওই দাবির প্রতিক্রিয়ায় ছোটনবাবু বলেছেন, “যে ভাবে কিষেণজি’কে মারা হল, তার পরে মাওবাদীদের সঙ্গে শান্তি আলোচনা আর কি সম্ভব? আমি আর মধ্যস্থতাকারী থাকতে চাই না। রাজ্য সরকারকে শীঘ্রই এ কথা জানিয়ে দেব।” মধ্যস্থতাকারী দলের অন্যতম সদস্য সুজাতবাবু অবশ্য পদত্যাগের ব্যাপারে সরাসরি কোনও মন্তব্য করেননি। তিনি বলেন, “ভারভারা কী বলেছেন, ভাল করে জেনে যা বলার বলব।”
তবে মধ্যস্থতাকারী দলের সদস্যেরা এর পরেও যদি শান্তি-প্রক্রিয়ার চেষ্টা করেন, তাতে যে আর মাওবাদীরা সাড়া দেবে না, এ দিন দলের পক্ষ থেকে তা স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। সিপিআই (মাওবাদী)-র কেন্দ্রীয় কমিটির এক নেতা বলেন, “এর আগে এই ভাবে আলোচনার দোহাই দিয়ে আজাদকে ডেকে এনে খুন করেছিল অন্ধ্রপ্রদেশের পুলিশ। আর যে কিষেণজি মমতাকে মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে দেখতে চেয়েছিলেন, তাঁকে আলোচনার জন্য ডেকে এনে খুন করল তাঁরই পুলিশ! এর পরে দেশের আর কোথাও এ ভাবে শান্তি আলোচনার পথে যাওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।” আজ, শনি ও কাল, রবিবার মাওবাদীরা বাংলা বন্ধেরও ডাক দিয়েছে।
ভারভারা, দীপা এবং এপিডিআরের সাধারণ সম্পাদক দেবপ্রসাদ রায়চৌধুরী এবং সহ-সভাপতি অমিতদ্যুতি কুমার এ দিন মহাকরণে গিয়ে স্বরাষ্ট্রসচিবের সঙ্গে দেখা করেন। তাঁরা জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সুপারিশ মেনে কিষেণজি’র মৃত্যু নিয়ে তদন্ত এবং মৃতদেহ তাঁর পরিবারের হাতে সমর্পণের দাবি জানান। এপিডিআরের সভামঞ্চ থেকেই চন্দ্রশেখর বলেন, “বিভিন্ন সূত্রে আমরা জেনেছি, কিষেণজি’র সঙ্গে আরও চার জন ছিলেন। তাঁরা কোথায়?” প্রসঙ্গত, দক্ষিণ কলকাতার প্রচারে গিয়ে বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র এ দিন মন্তব্য করেছেন, “কিষেণজি মমতাকে মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে দেখতে চেয়ে ভালই পুরস্কার পেলেন!”
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.