বন্ধ্যত্বকরণের জন্য অ্যানাস্থেশিয়া করতে গিয়ে তৈরি হল ‘জটিলতা’। তার জেরে প্রাণসংশয় ঘটেছে এক রোগিণীর। সুভাষগ্রাম হাসপাতালের এই ঘটনা বন্ধ্যত্বকরণ কর্মসূচিকে যথেষ্ট ধাক্কা দেবে বলে স্বাস্থ্যকর্তাদের আশঙ্কা।
জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশন কিছু দিন আগেই সুভাষগ্রাম হাসপাতালকে ‘মডেল হাসপাতাল’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। সেখানেই এমন ঘটনা অস্বস্তিতে ফেলেছে স্বাস্থ্যকর্তাদের। প্রশ্ন উঠেছে বন্ধ্যত্বকরণের মতো একটি জাতীয় কর্মসূচি, যাকে জনপ্রিয় করার জন্য আর্থিক সুবিধা-সহ নানা ইনসেনটিভ’ চালু করেছে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার, তা নিয়ে চিকিৎসকেরা আরও সতর্ক হবেন না কেন? ইতিমধ্যেই এ নিয়ে তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। গঠিত হয়েছে উচ্চ পর্যায়ের মেডিক্যাল বোর্ডও। মিতালি সিংহ (৩০) নামে ওই রোগিণী এখন এম আর বাঙুর হাসপাতালের আইটিইউ-এ ভর্তি রয়েছেন। হাসপাতাল সূত্রের খবর, তাঁর অবস্থা অত্যন্ত সঙ্কটজনক।
দক্ষিণ ২৪ পরগণার রাঘবপুরের বাসিন্দা মিতালি সিংহ গত ১১ নভেম্বর সুভাষগ্রাম হাসপাতালে বন্ধ্যত্বকরণ করাতে আসেন। তাঁর পরিবারের বক্তব্য, ওই দিন অপারেশন শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই কয়েক জন চিকিৎসক তাঁদের জানান, রোগিণীর অবস্থার হঠাৎ অবনতি ঘটেছে। তাঁকে অন্যত্র পাঠাতে হবে। কেন অবনতি ঘটল, সে বিষয়ে গোড়ায় চিকিৎসকেরা কিছুই জানাননি বলে অভিযোগ। এর পরে চিকিৎসকেরাই অ্যাম্বুল্যান্সের ব্যবস্থা করে তাঁকে এম আর বাঙুরে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। সেই থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত বাঙুরের আইটিইউ-এই রয়েছেন মিতালি।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মিতালির পরিবারের লোকজনকে কোনও আশার কথা শোনাতে পারেননি। এমনকী মিতালিদেবীর ঠিক কী হয়েছে, সে কথাও তাঁরা জানাতে চাননি বলে অভিযোগ। মিতালির স্বামী রঞ্জিত সিংহর দাবি, “অ্যানাস্থেশিয়া করার সময় কিছু সমস্যা হয়েছিল বলে আমাকে জানানো হয়েছে। আর কিছুই বিশদ জানি না।” বাঙুরের সুপার কাজলকৃষ্ণ বণিক বলেন, “অবস্থা খুব খারাপ। এখানকার চিকিৎসকেরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন। কিন্তু কোনও চেষ্টাই কাজে লাগছে না। বাড়ির লোককে মৌখিক ভাবে সব বুঝিয়ে বলেছি। আদালতের নির্দেশ ছাড়া কাগজপত্র দেওয়া যাবে না, তাই দিতে পারিনি।”
বিশেষজ্ঞদের মতে, বন্ধ্যত্বকরণ বা লাইগেশনের মতো অতি সাধারণ এবং ছোট একটি প্রক্রিয়ায় জীবনসংশয়ের নজির খুবই কম। তা হলে কী হল মিতালির? স্বাস্থ্যকর্তারাও প্রাথমিক ভাবে বলছেন, অ্যানাস্থেশিয়া করার সময়েই জটিলতা শুরু হয়েছিল। এই জাতীয় অস্ত্রোপচারে লোকাল অ্যানাস্থেশিয়া করার কথা। মিতালিকে জেনারেল অ্যানাস্থেশিয়া করা হয়েছিল। দক্ষিণ ২৪ পরগণার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক শিখা অধিকারী বলেন, “প্রাথমিক ভাবে যা জানা গিয়েছে, তাতে অস্ত্রোপচার শুরু হওয়ার পরে রোগিণী হঠাৎই অস্থির হয়ে ওঠেন। ওই অবস্থায় অস্ত্রোপচার বন্ধ করে দেওয়াও সম্ভব ছিল না। তাই জেনারেল অ্যানাস্থেশিয়া করতে হয়েছিল।” তার থেকেই জীবনসংশয়? স্ত্রীরোগ চিকিৎসক সঞ্জীব মুখোপাধ্যায় বলেন, “লোকাল অ্যানাস্থেশিয়ার জন্য রোগীকে এক রকম ভাবে প্রস্তুত করা হয়, জেনারেল অ্যানাস্থেশিয়ার জন্য অন্য রকম ভাবে। আচমকা সিদ্ধান্ত বদলালে সমস্যা হতেই পারে। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসকের সামান্য ত্রুটিও রোগীর জীবনে বড় ধরনের বিপর্যয় আনতে পারে।”
সুভাষগ্রাম হাসপাতালের যে চিকিৎসক মিতালির বন্ধ্যত্বকরণ করেছিলেন, সেই ত্রিদিবরঞ্জন কুন্ডু গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশনের কনসালট্যান্ট গাইনিকলজিস্ট। তিনি বলেন, “আমার তরফে কোনও সমস্যা হয়নি। অস্ত্রোপচারে সমস্যা হলে রোগী এখনও বেঁচে থাকতেন না। যত দূর শুনেছি, মিতালি সিংহের হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল।” অ্যানাস্থেশিয়ার সময়ে ঠিক কী সমস্যা হয়েছিল? তিনি বলেন, “সেটা বলতে পারব না। আমি অস্ত্রোপচার নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম।” বুলবুল রায় নামে যে চিকিৎসক অ্যানাস্থেশিয়ার দায়িত্বে ছিলেন তিনি আপাতত ছুটিতে। অনেক চেষ্টা করেও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকের কথায়, “সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকেরা দাবি করেছেন, জেনারেল অ্যানাস্থেশিয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সব সরঞ্জামই মজুত ছিল। দেখা যাক, তদন্ত রিপোর্টে কী আসে।”
মিতালির স্বামী রঞ্জিত সিংহ পেশায় অটোচালক। ছয় ও চার বছরের দুটি সন্তান আছে তাঁর। রঞ্জিতবাবু বলেন, “গ্রামের এক স্বাস্থ্যকর্মী অনেক বুঝিয়ে লাইগেশন-এর জন্য রাজি করিয়েছিলেন। তখনও ভাবিনি এমন সর্বনাশ হতে চলেছে।” এর ফলে কি লাইগেশন কর্মসূচিই প্রশ্নের মুখে পড়বে? আশঙ্কা উড়িয়ে না দিয়ে স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ সঞ্জীব মুখোপাধ্যায় বলেন, “কোনও গন্ডগ্রাম নয়, কলকাতা থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরত্বে এমন ঘটনা খুবই দুর্ভাগ্যজনক।” |