|
|
|
|
প্রবন্ধ ২... |
ফিল্ম উৎসবে বদল এসেছে
এ বার সরকার সরে যাক |
গৌতম চক্রবর্তী |
েক্ষত্র প্রস্তুত। ১৭তম কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবের আট দিন নেতাজি ইন্ডোর থেকে নন্দন, নিউ এম্পায়ার চক্কর দিতে দিতে মনে হল, মাহেন্দ্রক্ষণ সমাগত। রাজ্য সরকারের চলচ্চিত্র উৎসব থেকে হাত গুটিয়ে নেওয়ার সময় এসেছে। এমনিতেই কোনও সিনেমা-উৎসব সরকারি উদ্যোগে হওয়ার কথা নয়। কান, বার্লিন, ভেনিস, টরন্টো থেকে বুসান কোথাও হয়ও না। ১৭ বছর আগে সরকারি বদান্যতায় কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসব শুরু হওয়ার পিছনে একটা ছোট্ট ‘আমরা-ওরা’ ছিল। নেহরুর আমল থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের বদান্যতায় আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব চলছে। এখন যা গোয়ার ‘ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল অব ইন্ডিয়া’ (ইফি)। ফলে, নন্দন তৈরির পর বাম সরকারের একটা ‘রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ’ ছিল। ওরা করলে আমরাই বা নয় কেন! অতএব, সরকারি উদ্যোগে ফিল্মোৎসবের ভ্রান্তিবিলাস।
সেই ভ্রান্তি সমানে চলল, এ বারেও। তবু জনমানসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটা কৃতিত্ব রয়ে গেল। ‘জনতার উৎসব’ ব্যাপারটাই ধরুন। হাজার হাজার মানুষ শুধু শাহরুখ খানকে দেখতেই ইন্ডোরে গেলেন? টিভির সামনে বসে থাকলেন? এত একনিষ্ঠ ভক্ত থাকলে কয়েক সপ্তাহ আগে শাহরুখের ‘রা ওয়ান’ মুখ থুবড়ে পড়ত কি?
শাহরুখ ছাড়াও জনতার অন্য উৎসাহ ছিল। ক্ষমতার প্রতীকচিহ্নটি গুঁড়িয়ে যাওয়া। গত কয়েক বছর নন্দন নিছক সিনেমা-হল ছিল না। সব সময়েই ওয়্যারলেস-ভ্যান, হুটার, বেশ কিছু পুলিশ। যে কোনও সময়ে তারা রূঢ় ভঙ্গিতে জানায়, ‘‘সরে যান। সি এম আসছেন।’’ নন্দন তখন হয়ে উঠেছে ‘ক্ষমতা’র দ্বিতীয় পীঠস্থান। নেতাজি ইন্ডোরে উদ্বোধন তাই নিছক স্থানবদল নয়, নিঃশব্দ বিপ্লব।
কিন্তু জনমানস আরও বড় কিছুর অপেক্ষায়। বছর ছয়েক আগেও এই উৎসবে ‘ভেনু’ হিসাবে গিরিশ মঞ্চ বা মধুসূদন মঞ্চের মতো কিছু সরকারি নাটকের হল থাকত। ক্রমে সেগুলি বাতিল হয়, প্রিয়া, স্টার বা নবীনার মতো বেসরকারি সিনেমা হলও উৎসবে অংশ নেয়। এ বারই প্রথম মাল্টিপ্লেক্সেও উৎসবের ছবি দেখানো হল। বেসরকারি হল, মাল্টিপ্লেক্স কেন উৎসবে তুরস্ক, আজারবাইজান বা চিলির ছবি দেখায়? কারণ, তৈরি বাজার। পাড়ার দোকানেও বার্গম্যান, কুরোসাওয়ার ডিভিডি। ঘরে বসে ‘টরেন্ট’ থেকে বিদেশি ছবি ডাউনলোডিং। ‘ইউটিভি ওয়ার্ল্ড মুভিজ’ চ্যানেলে লাতিন আমেরিকা, ইউরোপ, এশিয়ার ছবি। এই বাজারে সরকারি ফিল্মোৎসব? কেন?
সরকারি পৃষ্ঠপোষণায় ‘সিনেমা উৎসব’ আসলে ‘ক্ষমতা’র একটা ছক! প্রাচীনতম চলচ্চিত্র উৎসব ‘ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভাল’ আগামী বছর আশি পার হবে। ১৯৩২ সালে ইতালির রাষ্ট্রনায়কের ব্যক্তিগত উৎসাহে এই উৎসব শুরু, সেখানে সেরা ছবি ‘গোল্ডেন লায়ন’ পুরস্কারে সম্মানিত হয়। নায়কের নাম? বেনিতো মুসোলিনি। প্রথম দশ বছর ওই পুরস্কারের নাম ছিল ‘মুসোলিনি কাপ’। সিনেমা জনপ্রিয় মাধ্যম, দেশবিদেশের সিনেমার উৎসব করে জনপ্রিয় হও এটাই ছিল নায়কের বুদ্ধি। ‘ফাসিস্ত’ মুসোলিনি অবশ্য এ ব্যাপারে ‘কমিউনিস্ট’ লেনিনের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছিলেন। রুশ বিপ্লবের পর প্রথম ফিল্ম স্কুল লেনিনের উৎসাহেই গড়ে ওঠে। কেন না, সিনেমাকে চমৎকার ভাবে প্রচারের কাজে লাগানো যায়। ‘সিনেমাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিল্পমাধ্যম’, লেনিন উবাচ। সুতরাং, কান বা বার্লিন-এর সঙ্গে পাল্লা দিতে মস্কোয় চলচ্চিত্র উৎসব শুরু। ‘আমরা সমাজতান্ত্রিক দেশরাও পারি।’ ফিল্মোৎসব আসলে রাজনীতির একটা তরিকা।
সেই তরিকা বেয়েই পশ্চিমবঙ্গ সরকারের হাতে এখন নন্দন এবং ফিল্মোৎসবের পাশাপাশি টেকনিশিয়ান্স স্টুডিয়ো, রূপায়ণ নামে একটি রুগ্ণ কালার ল্যাব, রূপকলা নামে একটি চলচ্চিত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, চ্যাপলিন নামে একটি বন্ধ সিনেমা হল। এই সব স্বাস্থ্যবান এবং রুগ্ণ স্টুডিয়ো, কালার ল্যাব, সিনেমা হল চালানো সরকারের কাজ নয়। ‘ভাল সিনেমা এবং চলচ্চিত্রশিক্ষার প্রসার’ ঘটানোও তার দায়িত্ব নয়। ত্রুফো, গদারের দেশেও চলচ্চিত্রকে ‘বিশুদ্ধ শিল্প’ ভাবা হয় না। চিত্রকলা, সাহিত্য, সঙ্গীত যতটা ‘বিশুদ্ধ’, সিনেমা ততটা নয়। প্রযুক্তি, প্রদর্শন-নেটওয়ার্ক, ছবির ব্যবসা ইত্যাদি নানা জিনিস জড়িয়ে থাকে। কলকাতায় চিত্রকলার সমঝদারি বেড়েছে বেসরকারি গ্যালারির হাত ধরে। সঙ্গীতসম্মেলন থেকে জ্যাজফেস্ট, সবই বেসরকারি উদ্যোগে। বিশুদ্ধ শিল্প পারলে, ‘ফিল্ম ব্যবসা’ও পারবে। তাই সাফল্যের স্বাদ নিয়েই রাজ্য সরকার ফিল্মোৎসব থেকে হাত গুটিয়ে নিতে পারে। সেটাই হবে আসল পরিবর্তন।
উৎসবের জন্য সরকারের কমিটি তৈরি করে দেওয়ারও দরকার নেই। অভিনেতা, প্রযোজক, পরিচালক, কলাকুশলী, ফিল্ম সোসাইটি, ফিল্ম স্কুল, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট সংস্থা, বিজ্ঞাপন সংস্থা মিলে তৈরি করুক কমিটি। কী ছবি দেখানো হবে, কোথা থেকে টাকা আসবে, তাদের বিবেচ্য। দরকার পরিবেশকদেরও। কান, বার্লিনে আমরা রবার্ট ডি নিরো, শ্যারন স্টোন, ঐশ্বর্যা রাইদের দেখে মুগ্ধ হই। কিন্তু ‘গ্ল্যামার কোশেন্ট’-এর আড়ালে পরিবেশক, প্রদর্শকদের যে কী বিরাট ভূমিকা থাকে! ক’বছর আগে ইতালীয় ছবি ‘লাইফ ইজ বিউটিফুল’ কানে সেরা ছবির পুরস্কার পেল, পরের দিনই ‘মিরাম্যাক্স’ সংস্থা আমেরিকায় তার প্রদর্শন-স্বত্ব কিনে নিল। কলকাতায়ও সে রকম ঘটতেই পারে। ধরা যাক, উৎসবের ‘ইন্ডিয়ান সিলেক্ট’ বিভাগে একটা ভাল তামিল ছবি দেখা গেল, স্থানীয় কোনও প্রদর্শক এখানে তার প্রদর্শন-স্বত্ব কিনলেন এখন মাল্টিপ্লেক্সেও তামিল ছবি চলে। উৎসবের বিভিন্ন বিভাগের জন্য স্পনসর খোঁজা যেতে পারে। গ্রুপ থিয়েটারেও স্পনসরের অনুদানে নাট্যোৎসব হয়। সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণালের শহর ফিল্মোৎসবের স্পনসর পাবে না? দরকারে টিকিটের দামও বাড়তে পারে। সারা বছর মাল্টিপ্লেক্সে ২৫০ টাকায় সিনেমার টিকিট কেনেন যিনি, ফিল্ম উৎসবে তাঁকে ৫০ টাকায় সিনেমা দেখাতে হবে কেন? সরকারি নিয়ন্ত্রণ থেকে বেরিয়ে বাণিজ্যের রাস্তা খুঁজলে উৎসবের মান কমবে না।
এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম উৎসবই সেই রাস্তা দেখিয়েছে। এ বার ছবি বাছাইয়ে ওপরমহলের কোনও হাত ছিল না। তবু গদার, বেলা টার, নুরি বিজ সিয়েলান, আব্বাস কিয়েরোস্তামির সাম্প্রতিকতম ছবি দেখা গিয়েছে। ছিল ‘টেকনিকাল কমিটি’, প্রোজেকশন থেকে সাউন্ড সিস্টেম সবই খুঁটিয়ে দেখে যথোপযুক্ত কারিগরি ব্যবস্থা নিয়েছিলেন তাঁরা। ফলে প্রদর্শনের মানও বেড়েছিল।
সরকারের ভূমিকা কী? উৎসবে সে পানীয় জল, পরিষ্কার রাস্তা থেকে দমকল, পুলিশ ইত্যাদি পরিষেবা দেবে। রাজস্থান পর্যটনের ওয়েবসাইটে বেসরকারি সাহিত্য উৎসবের জোরদার প্রচার চলে। উৎসবে অনেক বিদেশি আসেন, পরিষেবা দিয়েই রাজ্য সরকারের যথেষ্ট রাজস্ব আদায় হয়। এখানেও সে রকম ভাবা যেতেই পারে। কিন্তু সে সব পরের ভাবনা। প্রাথমিক কাজ একটিই। যে সরকারের ভাঁড়ে মা ভবানী, নন্দন চত্বরে ‘মেনল্যান্ড চায়না’র চিকেন, ‘বিজলি গ্রিল’-এর ফিশফ্রাই আর ‘বারিস্তা’র কফি খাওয়া জনতার উৎসবের জন্য সে ২ কোটি ৭৫ লক্ষ টাকা দেবে কেন? যুক্তি বলে, ওখানে সরকারি তহবিলের দু’পয়সাও যাওয়া উচিত নয়। |
|
|
|
|
|